Tuesday, July 15, 2014

সমাজ জীবনে যাকাতের স্থান

সমাজ জীবনে যাকাতের স্থান



কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে যাকাত-সদকা ইত্যাদির কথা বুঝার জন্য ইনসাফ ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা) বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে আবার বলা হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যা-ই খরচ করবে তা আল্লাহর কাছে করযে হাসান (ধার) হিসেবে মওজুদ থাকবে। এক কথায় এটা দ্বারা ঠিক আল্লাহকে ধার দেয়া হয়, আর আল্লাহ মানুষের কাছে ঋণী হন। অনেক স্থানে একথাও বলা হয়েছে যে, আল্লাহর রাস্তায় তোমরা যা কিছু দেবে তার বিনিময় দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর তিনি তোমাদের শুধু ততটুকু পরিমাণই ফিরিয়ে দেবেন না; তদপেক্ষা অনেক বেশী পরিমাণ দান করবেন।

কুরআন মজীদের উল্লেখিত কথাগুলো বাস্তবিকভাবেই প্রণিধানযোগ্য। আকাশ ও পৃথিবীর মালিক কি কখনও মুখাপেক্ষী হতে পারে? মানুষের কাছে থেকে সেই মহান পবিত্র আল্লাহর টাকা ধার নেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? সেই রাজাধিরাজ সীমাসংখ্যাহীন ধন ভান্ডারের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ কি মানুষের কাছে নিজের প্রয়োজন ধার চান? কখনও নয়, তা হতেই পারে না। তাঁর দানেই দুনিয়ার জীব-জন্তু বস্তুনিচয় জীবন ধারণ করছে, তাঁর দেয়া জীবিকা দ্বারাই মানুষ বাঁচে। দুনিয়ার প্রত্যেক ধনী ও গরীবের কাছে যা কিছু আছে, তা সব তাঁরই দান। একজন অসহায় গরীব থেকে শুরু করে কোটিপতি পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাঁর অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী। কিন্তু তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি মানুষের কাছে ধার চাইবেন এবং নিজের জন্য মানুষের সামনে হাত প্রসারিত করবেন- তার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। মূলত মানুষেরই কল্যাণের জন্য, মানুষের কাজে ব্যয় করার জন্যই তিনি আদেশ করেন। আর সে ব্যয়টাকেই তিনি তাঁর পথে খরচ কিংবা ধার বলে গণ্য করেন। বস্তুত এটাও তাঁর আর এক কল্যাণ কামনার বাস্তব প্রকাশ-এটাও তাঁর এক প্রকার বড় অনুগ্রহ বিশেষ। তিনি বলেন, তোমরা তোমাদেরই সমাজের অভাবগ্রস্ত গরীব এবং আর এক কল্যাণ কামনার বাস্তব প্রকাশ-এটাও তাঁর এক প্রকার বড় অনুগ্রহ বিশেষ। তিনি বলেন, তোমরা যেসব লোককে অর্থ সাহায্য কর, এর বিনিময় তারা কোথা থেকে দেবে? এর প্রতিদান আমিই দান করবো। তোমরা ইয়াতিম, বিধবা, অসহায়, বিপদগ্রস্ত এবং নিসম্বল পথিক ভাইদেরকে যা কিছু দান করবে তার হিসেব আমার নামে লিখে রেখো এর তাগাদা তাদের কাছে নয় বরং আমার কাছে কারো। আমি তা পরিশোধ করবো। তোমরা তোমাদের গরীব ভাইদের ধার দাও কিন্তু তাদের কাছ থেকে সুদ গ্রহণ করে না, এর তাগাদা করে তাদেরকে অপ্রস্তুত ও বিব্রত করো না। তারা ঋণ শোধ করতে না পারলে সে জন্য তাদেরকে সিভিল জেল পাঠিয়ো না, তাদের কাপড়-চোপড় এবং ঘরের আসবাবপত্র ক্রোক করো না, তাদের অসহায় সন্তানদেরকে ঘর থেকে বের করে আশ্রয়হীন করে দিও না। কারণ তোমাদের ঋণ আদায়ের দায়িত্ব তাদের নয়- আমার, তারা যদি মূল টাকা আদায় করে দেয়, তবে তাদের পক্ষে থেকে সুদ আমি আদায় করবো আর তারা যদি আসল টাকাও না দিতে পারে, তাহলে আসল ও সুদ সবই আমি শোধ করবো। এভাবে নিজেদের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে মানুষের উপকারার্থে তোমরা যা খরচ, করবে, তার লাভ যদিও তোমরাই পাবে; কিন্তু সেই অনুগ্রহ আমার ওপর করা হবে, আমিই তার লাভ সহ পূর্ণ হিসেব করে তোমাদেরকে ফেরত দেব।

একমাত্র দয়াময়, রাজাধিরাজ আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের যথার্থতা এখানেই মানব জাতির কাছে যা কিছু আছে, তা সব তাঁরই দান- অন্য কোথাও থেকে বা অন্য কারো কাছ থেকে তোমরা তা পাও না। তাঁরই ভান্ডার থেকে তোমরা নিয়ে থাক, কিন্তু যা কিছু দাও, তাকেঁ নয়-তোমাদরই আত্মীয়, এগানো, ভাই, বন্ধু ও নিজ জাতির লোকদেরকেই দিয়ে থাক। কিংবা নিজেদের সামাজিক কলাণমূলক কাজে ব্যয় কর, যার ফলও শেষ পর্যন্ত তোমরাই পেয় থাক। কিন্তু সেই মহান দাতার অসীম বদান্যতা লক্ষ্য কর, তিনি এ সকল দান সম্পর্কে বলেন যে, এটা তাঁকে ঋণ দেয়া হয়েছে, তাঁরই পথে খরচ করা হয়েছে, তাঁকে দেয়া হয়েছে-এর ফল আমিই তোমাদেরকে দেব। বস্তুত বদান্যতার এ অতুলনীয় পরাকাষ্ঠা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই পক্ষে শোভা পায়, কোনো মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না।

ভাবার বিষয় এই যে, আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে দানশীলতা ও বদান্যতার উৎস সঞ্চার করার জন্য এ পন্থা অবলম্বন করলেন কেন? এ বিষয়ে যতই চিন্তা করা যায়, ইসলামের উন্নত শিক্ষার অন্তনির্হিত পবিত্র ভাবধারা ততই সুস্পষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করা যায়; মন উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠে –এ অতুলনীয় শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হতে পারে না

মানুষ যে স্বভাবাতই কিছুটা যালেম এবং জাহেল হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তার সকলেরই জানা কথা। তার দৃষ্টি অত্যন্ত সংকীর্ণ। বেশী দূর পর্যন্ত তা পৌঁছায় না। তাদের দিল খুবই ক্ষুদ্র, তার মনে বড় এবং উচ্চ ধারণার খুব কমই সংকুলান হয়ে থাকে। মানুষ ভয়ানক স্বার্থপর, কিন্তু সেই স্বার্থপরতা সম্পর্কেও কোনো ব্যাপক ও বিরটি ধারণা তার মন-মস্তিষ্কে স্থান পায় না। মানুষ অবিলম্বেই সবকিছু পেতে চায়: خَلَقَ الاِنْسَانَ مِنْ عَجَلٍ ـ প্রতিটি কাজের ফল এবং পরিণাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাভ করতে সে প্রয়াসী। যে ফল তার সামনে অবিলম্বে আসে এবং নিজের চোখ দ্বারা দেখতে পায়, তাই তার কাছে একমাত্র ফল ও পরিণাম। সুদূরপ্রসারী ফলাফল পর্যন্ত তার দৃষ্টি মোটেই পৌঁছায় না। উপরন্তু যে ফল খুব বড় আকারে সামনে আসে এবং যে ফলের ক্রিয়া বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়, মানুষ তা অনুভব পর্যন্ত করতে পারে না। বস্তুত এটা মানুষের এক স্বাভাবিক দুর্বলতা বিশেষ। এ দুর্বলতার কারণে মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। আর তাও আবার যেসব স্বার্থ ছোট আকারে এবং খুব দ্রুত লাভ করা যায়, তারই প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। সে বলে আমি যা উপার্জন করেছি বা আমার বাপ-দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছি তা একান্তভাবে আমার, অন্য কারো কোনো অংশ বা অধিকার তাতে নেই। কাজেই আমি কেবল নিজের প্রয়োজনে, নিজের ইচ্ছায় এবং নিজের আরাম আয়েশের কাজে খরচ করবো। কিংবা যেসব কাজের ফল অবিলম্বে আমার হাতে ফিরে পাব কেবল সেই কাজে নিয়োগ করবো। আমি যদি টাকা খরচ করি তবে এর বিনিময় আমার মান-সম্মান বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা কোনো খেতাব লাভ করা একান্তই আবশ্যক। মানুষ যেন আমার সামনে মাথা নত করে, লোকের মুখে যেন আমার নামের চর্চা হয়। এসব জিনিসের কোনোটাই যদি আমি না পাই, তবে আমি টাকা খরচ করবো কেন? আমরা নিকটবর্তী কোনো গরীব-দু:খী বা ইয়াতীম মিসকিন যদি না খেয়ে মরে যায়, তবুও আমি কেন তাঁকে খাদ্য যোগাড় করে দেব? তার প্রতি তার পিতার কর্তব্য ছিল নিজের সন্তানের জন্য কিছু রেখে যাওয়া। আমার পাড়ার কোনো বিধবার যদি দু:খে দিন কাটে তবে আমার তাতে কি আসে যায়? তার জন্য তার স্বামীর চিন্তা করা উচিত ছিল। কোনো প্রবাসী যদি সম্বলহীন হয়ে পড়ে, তবে তার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? সে পথের ব্যবস্থা না করেই ঘর থেকে বের হয়ে বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে। অন্য কোনো ব্যক্তি যদি দূরবস্থায় পড়ে তবে তার প্রতি আমার কী করণীয় থাকতে পারে? আমার ন্যায় তাকেও আল্লাহ তাআলা হাত-পা দিয়েছেন। নিজের প্রয়োজন পরিমাণ উপার্জন করা তার নিজেরই কর্তব্য। আমি তার সাহায্য করবো কেন? আর একান্তই আমি তাকে যদি কিছু টাকা-পয়সা দেই তবে ঋণ হিসেবেই দেব এবং আসল টাকার সাথে এর সুদও নিশ্চয়ই আদায় করবো। কারণ, বিনা পরিশ্রমে তো টাকা উপার্জিত হয়নি। সেই টাকা আামার কাছে থাকলে কত কাজেই না লাগাতে পারতাম-দালান-কোঠা তৈরি করতে পারতাম, মোটর গাড়ি কিনতে পারতাম কিংবা অন্য কোনো লাভজনক কাজে খাটাতে পারতাম। সে যদি আমার টাকা দিয়ে কোনো উপকার লাভ করতে পারে, তবে আমি আমার টাকা দ্বারা কিচু না কিছু লাভ করতে পারবে না কেন? তা থেকে আমার অংশই বা আমি আদায় করবো না কেন?

এরূপ স্বার্থপর মনোবৃত্তির কারণে প্রথমত মানুষ ধনপিশাচে পরিণত হয়। সে তা খরচ করলে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই করবে। যে কাজে কোনো স্বার্থ দেখতে পাবে না, সেখানে এক পয়সাও খরচ করবে না। কোনো গরীবের সাহায্য যদি সে করেও, তবে মূলত তা দ্বারা সেই গরীবের কোনো সাহায্য হবে না, বরং তাকে আরো বেশী করে শোষণ করবে এবং তাকে যা দেবে তদপেক্ষা অনেক বেশী আদায় করবে। কোনো মিসকীনকে কিছু দান করলে সে এ ব্যক্তির প্রতি নিজের অনুগ্রহ দেখিয়ে তাকে কাতর করে ছাড়বে এবং তাকে এতদূর অপমানিত ও লাঞ্চিত করবে যে, তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধটুকুও অবশিষ্ট থাকতে দেবে না। কোনো জাতীয় কাজে অংশ গ্রহণ করলে এ ধরনের মানুষ সর্বপ্রথম নিজের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেবে। যেসব কাজে নিজের স্বার্থ লাভের সম্ভবনা থাকবে না, সেই কাজে একটি পয়সাও দিতে প্রস্তুত হবে না।

এধরনের মনোবৃত্তির পরিণাম কত ভয়াবহ তা ভেবে দেখেছেন কি? এর ফলে গোটা সমাজ জীবনই যে চুরমার হয়ে যাবে তাই নয়, বরং শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির অবস্থাও অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে পড়বে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এদের দৃষ্টি অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং তারা অতীব মূর্খ বলে এটা থেকেও তাদের নিজেদেরই উপকারিতার আশা করে থাকে। এ ধরনের হীন মনোবৃত্তি যখনই মানুষের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন সমাজের খুব অল্প সংখ্যক লোকের হাতে সমগ্র জাতীয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে এবং অসংখ্য লোক একেবারে নিরুপায় ও উপর্জনহীন হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। অর্থশালী লোক অর্থের বলে আরও বেশী পরিমাণ অর্থ শোষণ করে, গরীব লোকদের জীভন ক্রমশ আরও বেশী খারাপ হয়ে যায়। যে সমাজে দারিদ্র একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক স্বাস্থ্য-ধৈর্য চূর্ণ হয়, নানা প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি সমাজ দেহে আক্রমণ করে, ফলে তারা কাজের ও উৎপাদনের শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে মূর্খতা ও অশিক্ষা বৃদ্ধি পায়, নৈতিক স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তারা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অপরাধ প্রবণ হতে বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত লুটতরাজ করতেও পশ্চাৎ পদ হয় না। সমাজে এক সর্বব্যাপী বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়, ধনী লোক গরীবদের হাতে নিহত হতে শুরু করে, তাদের ঘর-বাড়ী লুণ্ঠিত হয়, অগ্নিদগ্ধ হয় এবং তারা চিরতরে ধ্বংস হতে বাধ্য হয়।

সমাজ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত কল্যাণ তার সামাজিক বৃহত্তর কল্যাণের সাথে ওতপ্রোত জড়িত। একজনের কাছে যে অর্থ আছে তা যদি অন্য এক ভাইয়ের সাহায্যার্থে ব্যয়িত হয় তবে এ অর্থই আবর্তিত হয়ে অভাবিতপূর্ব কল্যাণ নিয়ে পুনরায় তার হাতেই ফিরে আসবে। পক্ষান্তরে নিতান্ত সংকীর্ণ দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে যদি সে তার নিজের কাছেই সঞ্চয় করে রাখে, কিংবা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থজনিত কাজে ব্যয় করে, তবে ফলত সে অর্থ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি ইয়াতীম শিশুকে আপনি যদি লালন-পালন করে এবং উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে উপার্জনক্ষম করে দেন, তবে তাতে সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। আপনিও তা থেকে অংশ লাভ করতে পারবেন। কারণ, আপনিও সেই সমাজেরই একজন লোক। হতে পারে সেই ইয়াতীমের বিশেষ যোগ্যতার ফলে আপনি যে অর্থ লাভ করেছেন তা কোনো হিসেবের সাহায্যে হয়ত আপনি যে অর্থ লাভ করেছেন তা কোনো হিসেবের সাহায্য হয়ত আপনি আদৌ জানতে পারেননি। কিন্তু প্রথমেই তার লালন-পালন করতে এবং তাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিতে আপনি যদি অস্বীকার করেন এবং বলেন যে, আমি তার সাহায্য করবো কেন, তার পিতারই কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে যাওয়া উচিত ছিল, তবে তো সে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবে, ছন্নছাড়া হয়ে নিরুদ্দেশ হাতড়িয়ে মরবে, অকর্মণ্য হয়ে যাবে এবং সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি করার মতো কোনো যোগ্যতাই সে লাভ করতে পারবে না। বরং সে অপরাধ প্রবণ হয়ে একদা স্বয়ং আপনার ঘরেই সিঁদ কাটতে প্রস্তত হবে। এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, আপনি সমাজেরই এক ব্যক্তিকে অকর্মণ্য ও অপরাধ প্রবণ বানিয়ে কেবল তারই নয়-আপনার নিজরও ক্ষতি সাধন করবেন। এ একটি মাত্র উদাহরণ সামনে রেখে দৃষ্টি প্রসারিত করলে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে যে, নিস্বার্থভাবে যে ব্যক্তি সামাজিক বৃহত্তর কল্যাণের জন্য অর্থ খরচ করে, বাহ্য দৃষ্টিতে তা তার নিজ পকেট থেকে নির্গত হয় বটে; কিন্তু বাইরে এসে তাই বৃদ্ধি পেয় স্ফীত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাই অসংখ্য রূপ উপকার ও স্বার্থকতা নিয়ে আবার তার পকেটেই ফিরে যায়। আর যে ব্যক্তি দৃষ্টিতে তার অর্থ তার নিজের বাক্সে থেকে যায় বা সুদ খেয়ে তাকে আরও স্ফীত করে তোলে; কিন্তু প্রকতপক্ষে নিজের নির্বুদ্ধিতার দারুনই নিজের সম্পদ নষ্ট করে-নিজেরই ধ্বংসের ব্যবস্থা করে।
আল্লাহ তাআলা এ তত্ত্ব কথাই বলেছেন নিন্মলিখিত আয়াতে:

يَمْحَقُ اللهُ ارِّبوْا وَيُرْبِى الصَّدَقتِ ـ البقرة : 276
আল্লাহ সুদ নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দানকে ক্রমবৃদ্ধি প্রাপ্ত করেন।
وَمَا اتَيْتُمْ مِّنْ رٍّبًا زَكوْةٍ تُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَاُوْلئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ ـ الروم : 39

মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করবে বলে তোমরা যে সুদ দাও, মূলত আল্লাহর কাছে তাতে সম্পদ মোটই বৃদ্ধি পায় না কিন্তু তোমরা য যাকাত আদায় কর-একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভ করার উদ্দেশ্য তা অবশ্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। সূরা আর রূম : ৩৯
কিন্তু এ গভীর তত্ত্ব কথা বুঝতে এবং তদানুযায়ী কাজ করতে মানুষের দৃষ্টি সংকীর্ণতা এবং চরম মূর্খতা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ইন্দ্রিয়ের দাস। যে টাকা তাদের পকেটে আছে তা দিয়ে তারা অনুভব করতে পারে এবং বুঝতে পারে যে, তা নিশ্চয়ই আছে। তাদের হিসেবের খাতায় যে পরিমাণ টাকা বেড়ে চলেছে তার ক্রম বৃদ্ধি সম্পর্কেও তারা নিসন্দেহ; কিন্তু যে টাকা তাদের কাছ থেকে চলে যায়; তা যে বাড়ছে এবং তাদের হাতে যে ফিরে আসতে পারে; সে কথা মোটেই বুঝতে ও দেখতে পায় না। তারা শুধু বুঝে এত টাকা আমার হাত থেকে চলে গিয়েছে এবং তা চিরকালের জন্যই গেছে।

মূর্খতার এ বন্ধনকে মানুষ নিজের বুদ্ধি বা চেষ্টার দ্বারা অদ্যাবধি খুলতে পারেনি। সারা দুনিয়ার অবস্থাই এরূপ। একদিকে পুজিঁবাদীদের দুনিয়া-সকল কাজই সেখানে সুদ প্রথার ওপর চলছে এবং ধন-সম্পদের প্রাচুর্য সত্ত্বেও সেই দেশে দু:খ দারিদ্র আর অভাব অনটন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে এদের বিরোধী আর একটি দল ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেছে। তাদের মনে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর পুঁজিবাদীদের ধন-ভান্ডার লুটে তো নেবেই সেই সাথে মানুষের তাহযীব-দমুদ্দনের গোটা ইমারতকেও ধূলিসাৎ করে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেছে।

মানুষ এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এর সুষ্ঠ সমাধান করেছে মানুষের স্রষ্টা-মহীয়ান গরীয়ান আল্লাহ তাআলা। তিনি এসব মানুষের অন্যান্য যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানসহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, তার নাম কুরআন মজীদ। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে মানুষকে আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনতে হবে। মানুষ যদি আল্লাহর এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনতে হবে। মানুষ যদি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে এবং সন্দেহাতীতরূপে জেনে নেয় যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমগ্র ধন-ভান্ডারের প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা : আর মানুষের সকল কাজের ব্যবস্থাপনা একান্তভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, তার কাছে প্রত্যেকটি অণু-পরমাণুর হিসেব বর্তমান আছে; মানুষের ভালো বা মন্দ কাজের পুরুস্কার বা শাস্তি আখেরাতে ঠিক তদনুযায়ী হবে। তাহলে নিজের স্থুলদৃষ্টির ওপর নির্ভর না করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজের ধন-সম্পদ আল্লাহর বিধান অনুসারে ব্যয়-ব্যবহার করা এবং লাভ-ক্ষতি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়া মানুষের পক্ষে খুবই সহজ হয়ে পড়ে। এরূপ ঈমান নিয়ে সে যা কিচু খরচ করবে তা একান্তভাবে আল্লাহর জন্যই খরচ করা হবে। তার হিসেবেও আল্লাহর দফতরে যথাযথভাবে লিখিত হবে। তার এ খরচের খবর দুনিয়ার কোনো মানুষ জানতে না পারলেও আল্লাহ তাআলা সেই সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত থাকেন। আর দুনিয়ার মানুষ তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলেও আল্লাহ নিজেই যখন তার প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করেছেন তখন পরকালেই হোক কিংবা ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানেই হোক-সেই ওয়াদা যে পূর্ণ হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
- See more at: http://www.ebanglalibrary.com/religious/?p=1384#sthash.3eTqGRyU.dpuf

প্রিয়নবীর মানবিকতা ও আমাদের জীবন

প্রিয়নবীর মানবিকতা ও আমাদের জীবন

Sirat 02
খন্দকার মনসুর আহমদ :
মানবতাকে শান্তি ও মুক্তির আলোকিত পথের সন্ধান দিতে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হযরত আদম আ. হতে যে মানবতার উদ্বোধন ঘটেছিলো তা সর্বোচ্চ উৎকর্ষে পৌঁছে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে তাঁর আগমনের মধ্য দিয়েই।
কোনো মতাদর্শের কালজয়ী সাফল্যার্জন তখনই সম্ভব হয়ে থাকে, যখন সে আদর্শের অগ্রপথিক আগে নিজ জীবনে সে আদর্শের যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। স্বীকৃত সত্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপন জীবনে তাঁর প্রচারিত আদর্শের যথাযথ ও চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছিলেন। আর তাই তাঁর প্রচারিত আদর্শ ও দীন মানবতার হৃদয়ে রেখাপাত করে সমুদ্রের উত্তাল ঊর্মিমালার উচ্ছলতায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সর্বত্র।
যুগে যুগে মুসলিম-অমুসলিম গবেষক, পণ্ডিত অনুসন্ধিৎসার আলোকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। আজও দেখছেন। অনুসন্ধানের পর তাবৎ সুস্থ বিবেক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম চরিত্র বলে অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই চরিত্রের অনুসরণ মানব স্বভাবের একান্ত দাবি। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা নবীজীর সেই বর্ণিল জীবনের কতিপয় মহান ঘটনা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। সেসব ঘটনায় প্রিয়নবীর সেই সর্বোত্তম মানবিক আখলাকের চমৎকার রূপায়ন ঘটেছে।
ক্ষমা ও উদারতা
১. মুক্তির নবী প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনা হিজরতের প্রাক্কালে কাফিরদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তক্রমে ঘোষিত হলো যে, মুহাম্মদকে হত্যাকারীর পুরস্কার একশত উট। প্রিয়নবীর সন্ধানে খোলা তলোয়ার হাতে চতুর্দিকে বেরিয়ে পড়লো কাফিরদের কয়েকটি দল। সুরাকা ইবনে মালিক পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চললো প্রিয়নবীর পথ ধরে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের উদ্দেশ্যে সঙ্গী আবু বকর রা.-কে নিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। সুরাকা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে ফেললো। কাছাকাছি চলে এলে তাঁর ঘোড়া প্রচণ্ড হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। কিন্তু সুরাকা দমবার পাত্র নয়; সে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধরতে উদ্যত হলো। এবার এতো কাছে পৌঁছে গেলো যে, নবীজীর কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পেলো। আবু বকর রা. কেঁদে ফেললেন, নবীজী তাঁকে অভয় দিলেন। সুরাকা তারপর খুব কাছে চলে এলো, এমন সময় নবীজীর দু’আয় মরুভূমির শক্ত জমিনে তার ঘোড়ার পা গেড়ে গেলো। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সে তার অশ্ব উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে নবীজীর কাছে দোয়ার অনুরোধ জানালে নবীজী তার অশ্ব উদ্ধারের জন্য দু’আ করেন। নবীজীর এহেন ক্ষমা ও মহত্ত্বে সুরাকার হৃদয়রাজ্যে এক নতুন বিল্পব শুরু হয়। কিছুকাল পরে সে ইসলামের চিরস্নিগ্ধ ছায়ায় আশ্রয় নেয়।১
২. হুবার বিন আসওয়াদ নামের এক ব্যক্তি ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রু ছিলো। অসংখ্য যুদ্ধে মুসলমানদেরকে রক্তাক্ত করেছে সে। এছাড়া তার সবচেয়ে বড়ো অপরাধ ছিলো সে প্রিয়নবীর কলিজার টুকরো
কন্যা হযরত জয়নবকে আঘাত করে উট থেকে ফেলে দিয়েছিলো। সে আঘাতেই কিছুদিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন।
মক্কা বিজয়ের পর হুবারের প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হলো, তখন নাঙ্গা তলোয়ার হাতে মুসলিম বীরগণ তাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। হুবার বিন আসওয়াদ পালিয়ে যাবার অনেক ফন্দি এঁটে ব্যর্থ হলো। নিরুপায় হয়ে সে হযরত রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে ক্ষমা চাইলো। এতো কালের অপরাধী প্রিয়নবীর সামনে উপস্থিত। উদারতার মূর্ত প্রতীক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সরল মনে ক্ষমা করে দিলেন। সাথে সাথে সে পড়ে নিলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’২
৩. মক্কা বিজিত হলো। মুসলমানদের দাপটে প্রকম্পিত চারদিক। মুসলমানদের দুশমনদের অন্যতম নেতা সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া সমুদ্রপথে পালিয়ে ইয়ামান চলে যাওয়ার জন্য জেদ্দায় গিয়ে আত্মগোপন করলো। উমাইর ইবনে ওয়াহাব নবীজীর খেদমতে গিয়ে আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের গোত্রপতি সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া  সমুদ্রপথে পালিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছেন।’ রহমতের নবীর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলোÑ ‘তাঁকে আমি নিরাপত্তা দিলাম।’ উমাইর পুনরায় আরজ করলেন, ‘নিরাপত্তার কোনো নিদর্শন দিলে বোধ হয় বিষয়টি তাঁকে নিশ্চিত করতো।’ নবীজী তাঁর পাগড়ি খুলে দিয়ে দিলেন। উমাইর গিয়ে সাফওয়ানকে খুলে বললেন সবকিছু। তবুও সম্পূর্ণ শঙ্কামুক্ত হয় না সাফওয়ানের মন। এই সেই সাফওয়ান যে একদিন উমাইরকে নিযুক্ত করেছিলো রহমতের নবীকে হত্যা করার জন্য। সারাজীবন কতো আঘাতে আঘাতে সে ব্যথিত করেছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হৃদয় মুবারক। সে সাফওয়ানকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাবিজয়ের এ মহাবিজয়ের মুহূর্তেও শাস্তি না দিয়ে নিশর্তভাবে ক্ষমা করে দিলেন। বিষয়টি একটু বিস্ময়কর ঠেকলো তার কাছে।
এরপর দ্বিধাসংশয়ের দোলায় দুলতে দুলতে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া হাজির হলো মক্কার নতুন অধিপতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে। এসেই প্রথমে ভীতিমিশ্রত কণ্ঠে আরজ করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, উমাইর বলে, আপনি নাকি আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন?’ জবাব এলো, ‘হ্যাঁ, সে সত্যিই বলেছে।’ সাফওয়ান পুনরায় নিবেদন করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে দু’মাসের সময় দিন।’ নবীজী বললেন, ‘ তোমাকে দু’মাস নয়, চার মাসের সময় দেয়া হলো।’
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন উদারতায় সাফওয়ানের হৃদয় গলে গেলো। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠলো তাঁর মন। দ্বিধা ও সংশয়ের বুকে আঘাত হেনে সে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। এরপর ইসলামের চিরস্নিগ্ধ ছায়ায় আশ্রয় নিতে দেরি হলো না তার।৩
এ হলো রাজনৈতিক জীবনে প্রিয়নবীজীর ক্ষমা ও উদারতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত। আমাদের রাজনৈতিক জীবনে সে মানবিক আদর্শের বড়ো অভাব আজ।
আজ আমাদের ভাবতে হবে, আবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই মহান আদর্শকে আমাদের জীবনে সর্বতোভাবে প্রতিফলিত করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করতে হবে।
ধৈর্য ও সহনশীলতা
১. একবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ইহুদির কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ে মূল্য পরিশোধের চুক্তিতে কোনো বস্তু ক্রয় করেছিলেন। কয়েকদিন পর সময়সীমা অতিক্রান্ত না হতেই হঠাৎ একদিন ইহুদি এসে হাজির। এসেই সে মূল্য পরিশোধের জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর টেনে ধরে কঠোর ভাষায় তাঁর প্রতি অশোভন বাক্যবাণ ছুঁড়তে লাগলো। ব্যঘ্রসেনা উমর রা. কাছেই ছিলেন। ক্রোধে তাঁর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে কেবল, রাগত কণ্ঠে সবিস্ময়ে বলে উঠলেনÑ রে পামর! তুই সত্যি সত্যি তাই বলেছিস আমি যা শুনেছি!’ এই বলে তিনি ইহুদিকে ধরতে উদ্যত হলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উমরকে নিবৃত্ত করলেন। বললেন, ‘এতো পাওনাদার এর কথা বলার অধিকার আছে।’
কিছুক্ষণ পর ইহুদি তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করলো। বিনীত কণ্ঠে নিবেদন করলো, আমি একজন ইহুদি যাজক। তাওরাতে আখেরি নবীর পরিচয় পেয়েছি। তিনি অস্বাভাবিক ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অধিকারী হবেন, ইনি সত্যিই সে হক নবী কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য এ হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েছি। এরপর নবীজীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করে নিলো।
২. হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিতÑ একবার এক মরুবাসী বেদুঈন এসে বললো, ‘তোমার কাছে যেসব মাল আছে এগুলি তোমারও নয় তোমার বাবারও নয়, এখন আমার দু’টি উট বোঝাই করে মাল দিয়ে দাও। কারণ এসব মাল হচ্ছে আল্লাহর, আর আমি আল্লাহর বান্দা।’ তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি যে আচরণ করেছো, এজন্য তোমার মোটেও ভয় হচ্ছে না?’ বেদুঈন জবাব দিলো, মোটেও না।
নবীজী তার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমি জানি তুমি দুর্ব্যবহারের জবাব
দুর্ব্যবহারের মাধ্যমে না দিয়ে ক্ষমার মাধ্যমে দিয়ে থাকো। লোকটির কথায় নবীজী হেসে ফেললেন এবং একটি উট বোঝাই করে যব, আরেকটি উট বোঝাই করে খেজুর দিয়ে দিলেন।
৩. একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে উমরের গৃহে গমন করলেন। নবীজির বসার জন্য আবদুল্লাহ একটি চামরার আসন পেতে দিলেন। কিন্তু রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওটার উপরে না বসে মাটিতে বসে পড়লেন। ফলে আসনটি আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যখানে পড়ে রইলো।
এ হলো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিনয়ের কয়েকটিমাত্র নজির। সৃষ্টির সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চে প্রশংসার অধিকারী হয়েই আল্লাহর রসূল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কেমন বিস্ময়কর বিনয়ের নমুনা দেখিয়ে গেলেন।
আমরা আজ এসব কথা প্রায় বিস্মিৃত হতে বসেছি। দারুণ অহংবোধ, অনর্থ আড়ম্বরের আয়োজন প্রায় সর্বত্র। আসুন বন্ধুরা, সীরাতে রসূলের আবেদনকে আমরা আমাদের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি। এবং আমলে মনোযোগ দিই। তবে আমরা তাঁর মহাব্বতের দাবিদার হতে পারবো।
সম্মান ও প্রশংসায় অতিরঞ্জনের প্রতি ঘৃণা
১. একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইরে কোথাও তাশরিফ নিয়ে গেলে উপস্থিত লোকজন তাঁর সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়নবী বিষয়টি পছন্দ করলেন না। তিনি ইরশাদ করলেন, ‘অনারবদের মতো সম্মান প্রদর্শনে দাঁড়িয়ে যাবে না।’৪
তিরমিযী শরীফের বর্ণনায় রয়েছে, হযরত আনাস রা. ইরশাদ করেন, ‘সাহাবায়ে কেরামের নিকট রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অধিক সম্মানিত কেউ ছিলো না। তদুপরি তাঁরা হযরতের অপছন্দের কারণে তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়াতেন না।’
আরেকবার নবীজী কোনো এক বিবাহ অনুষ্ঠানে তাশরিফ নিলেন। দুলার জন্য বিছানো চাদরে গিয়ে বসলেন। ঘরের ছোটো ছোটো মেয়েরা একত্র হয়ে দফ বাজিয়ে বদর যুদ্ধের শহীদানদের প্রতি নিবেদিত শোকগাথাগুলো আবৃত্তি করছিলো। এক পর্যায়ে তাদের একজন প্রিয়নবীর প্রশংসায় গেয়ে উঠলো, ‘ওয়া ফী-না নাবিয়্যুন ইয়া’লামু মা ফী গাদিন।’ অর্থাৎ, আমাদের মাঝে রয়েছেন এক নবী / আঁখির পলকে প্রতিভাত হয় যাঁর আগামী কালের ছবি। আল্লাহর নবী তখনই এ গান গাইতে বারণ করে বললেন, ‘এটা বাদ দাও; আগে যা গাইছিলে তাই গাও।’
২. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিশুপুত্র হযরত ইবরাহীম যেদিন ইন্তেকাল করেন কাকতালীয়ভাবে সেদিন সূর্যগ্রহণ হলো।
সবাই ভাবলো, নিশ্চয় এটা প্রিয়নবীর পুত্রের ইন্তোকলের ফলে ঘটেছে। শোকাহত আকাশ বুঝি এভাবে পালন করছে শোকÑ সবাই কাকতালীয় ঘটনাটিকে এভাবে নিলো।
ভাবুন তো, একজন যশাকাক্সক্ষী মানুষের জন্য এর চাইতে মহাসুযোগ আর কী হতে পারে! অতিমানবত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এর চেয়ে অনায়াস ব্যবস্থা আর কিইবা হতে পারে! এক্ষেত্রে শুধু মনোভাবই তো যথেষ্ট।
কিন্তু আল্লাহর রসূলের শান যে এর চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে! তিনি জনতাকে মসজিদে সমবেত করে স্পষ্ট ভাষণে জানিয়ে দিলেন, চন্দ্রগহণ ও সূর্যগ্রহণ আল্লাহর নিদর্শসমূহের দু’টি নিদর্শন। কারও জন্ম-মৃত্যুর কারণে এ দু’টির গ্রহণ ঘটে না।
সংক্ষিপ্ত কয়েকটি ঘটনায় আমরা আলোচ্য ক্ষেত্রে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেজাজ বুঝতে পারলাম। এই আত্মিক প্রশস্ততা ও স্বচ্ছতার বড়ো অভাব আমাদের মাঝে। প্রশংসাপ্রিয়তা, আত্মজ্ঞাপন প্রবণতা আমাদের মাঝে বড়ো প্রবল। এটা নিতান্ত খারাপ মনোভাব।
প্রশংসা ও সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন সম্মান ও প্রশংসাকারীর জন্য যেমন ঠিক নয়, তেমনি প্রশংসিত ও সম্মানপ্রদর্শিতের জন্যও তা কল্যাণকর নয়। এসবই অহংবোধের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়।
আমরা অনেকে আবার আত্মপ্রশংসায়ও মেতে উঠি যত্রতত্র। আত্মজ্ঞাপনের কোনো সুযোগই যেনো হাতছাড়া করতে চাই না। এসবই তো নবীজীর শিক্ষা ও মেজাজের পরিপন্থী। বন্ধুরা, আসুন আমরা পুনরায় আখলাকে নববীর আদর্শ নিয়ে একটু ভেবে দেখি, সেই মহান আদর্শকে বুকে ধারণ করে এসব মনোভাব ত্যাগ করি।
সততা
১. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার মদীনার অনতিদূরে তাঁবু ফেলা একটি কাফেলার পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। বণিকদের একটি উট নবীজীর খুব পছন্দ হলো। তিনি মালিকের নিকট উটটির মূল্য জিজ্ঞেস করেই উটের রশি ধরে বাড়ির পথে রওনা দিলেন। নবীজী চলে যাওয়ার পর হঠাৎ বণিকদের মাঝে চিন্তা এলোÑ একি! একজন অপরিচিত লোককে উট দিয়ে দিলাম সে যদি মূল্য নিয়ে আর ফিরে না আসে! এই ভেবে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ভর্ৎসনা করতে লাগলো। কাফেলার মাঝে এক বয়োবৃদ্ধা মহিলা ছিলো। সে তাদের আত্মভর্ৎসনা শুনে বলে উঠলো, ‘তোমরা এতাটা বিচলিত হলে কেনো? ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমি এমন দীপ্তিমান চেহারার অধিকারী মানুষ জীবনে কখনও দেখিনি। এ কোনো প্রতারকের চেহারা হতেই পারে না।’ এরপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটের মূল্য পাঠিয়ে দিলেন। সেই সাথে অতিরিক্ত দিলেন তাদের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী।
আরেক বারের ঘটনা। তিনি বিদেশি বণিকদের নিকট কতগুলো উট বিক্রি করলেন। তন্মধ্যে একটি উট ছিলো খুবই দুর্বল ও খোঁড়া। বণিকদল উট নিয়ে চলে গেলো। প্রিয়নবী ভাবলেন, তিনি তো বিক্রির সময় দুর্বল ও খোঁড়া উটটির কথা বণিকদেরতে বলে দেননি। তারা উটটির প্রতি খেয়াল করেনি বিধায় সুস্থ-সবল অন্যান্য উটের মূল্যে সেটিও কিনে নিলো। বিষয়টি তো বলে দেয়া দরকার ছিলো!
এরপর ঘোড়া ছুটিয়ে বণিকদের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন বিশ্বমানবতার সেরা আদর্শ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বণিক সরদার নবীজীকে দেখে অত্যন্ত বিস্মত কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ভাই আমরা তো আপনার মূল্য পরিশোধ করেই এসেছি, আপনি আবার কী জন্য এসেছেন?’ নবীজী তখন ব্যাপারটা খুলে বললেন। বণিকরা ভাবলো, লোকটা খুবই সহজ-সরল, নয়তো কেউ কি এভাবে ঠকতে চায়! তারা রসিকতা করে বলে উঠলো, ‘উট তো আমরা দেখে-শুনেই কিনেছি। খোঁড়া উট কিনে থাকলে সে তো আমাদেরই দোষ, এখন কি আর করা যাবে।’
নবীজী তাদেরকে বুঝাতে চাইলেন, খোঁড়া উটটির কথা তাদেরকে জানিয়ে দেয়া উচিত ছিলো, ভুলে তা বলে দেয়া হয়নি। ফাঁকিবাজির ব্যবসায় আল্লাহ নারাজ হবেন। এরপর তিনি অতিরিক্ত টাকা বণিকদেরকে ফেরত দিয়ে দিলেন।
নবীজীর এ আচরণ দেখে বণিকদের বিস্ময়ের অন্ত রইলো না। তারা অপূর্ব সততার শিক্ষা পেলো নবীজীর কাছ থেকে। এই ছিলো বিশ্বমানবতার আদর্শ হযরত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণিজ্যনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্যে অসৎ পন্থা অবলম্বন যেনো আমাদের সমাজে কোনো ব্যাপারই না। বিশেষত আমাদের শহুরে পরিবেশে এ ব্যাপারে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। ভালো যে কেউ নেই একেবারে তাই বলছি না। কিন্তু দু’চার জন যাঁরা এই প্রতিকূল ¯্রােতেও সৎ থাকতে চান তাঁরাও প্রতিকূল পরিবেশে বিপাকে পড়ে যান।
আজ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও আদর্শের ওপর অনড় থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে আমাদেরকে এবং নবীজীর সে সততার আহ্বান সমাজে বারবার প্রচার করতে হবে।
সাম্য
১. বদর যুদ্ধে যাত্রাকালে মুসলমানদের কাছে মাত্র কয়েকটি উট ছিলো। সিদ্ধান্ত হলো সাহাবায়ে কেরাম উটগুলো নিজেদের মাঝে ভাগাভাহি করে নেবেন। পালা বদল করে তাঁরা এগিয়ে যাবেন বদরের দিকে।
নিয়মানুযায়ী মহানবীর দলেও রয়েছেন দু’জন সাহাবী। তাঁরা ভাবলেন দু’জাহানের স¤্রাটও অন্যদের মতো পালা বদল করে উটে চড়বেন তা কী করে হয়! তারা নবীজীর খেদমতে এসে আবেদন করলেন, নবীজী পুরো পথ এককভাবে উটে চড়ে গেলে ভালো হয়। কিন্তু সেনাপতি রসূল তাতে রাজি হলেন না। সেনাপতি বলে তিনি আরাম করবেন আর সাধারণ সৈন্য বলে তারা পুরো পথ হেঁটে যাবেÑ এই বৈষম্য তিনি পছন্দ করলেন না। তিনি অন্যদের মতোই পালা বদল করে উটে চড়লেন।
এ ছিলো প্রিয়নবীর সাম্যনীতি। তাবৎ পৃথিবী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই শিক্ষা নিতে পারে এই নীতি থেকে। আজকের পৃথিবীতে ছোটো ও বড়োর যে বৈষম্য প্রায় সর্বত্র দেখা যায়, প্রিয়নবীর আদর্শের অনুসরণই কেবল তা দূর করতে পারে।
২. একবার হঠাৎ করে সংবাদ এসে পৌঁছলো যে, মুসলমানদের দুশমনেরা সম্মিলিতভাবে বিরাট রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে মদীনা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ শুনে সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মদীনার চতুর্দিকে পরিখা খনন করে শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দশজন দশজন দল করে দ্রুত কাজে নেমে পড়লেন। আল্লাহর নবী ঘুরে ঘুরে দেখলেন। এরপর বিলাল রা.-এর গ্রুপে এসে বললেনÑ ‘তোমাদের গ্রুপে যেহেতু নয় জন সুতরাং আমাকেও তোমাদের সঙ্গে নাও।’ সবাই কাজ করবে তিনি করবেন নাÑ এমনটি তাঁর পছন্দ নয়। তাই তাঁকে সাথে নিতেই হলো। এক পর্যায়ে বিলাল রা. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথায় এক টুকরি মাটি তুলে দিলেন। নবীজী বললেন, ‘আরেক টুকরি দাও।’ আরজ এলো, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, সবাই তো এক টুকরি করেই নিচ্ছে!’ আল্লাহর রসূল মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি তোমাদের মতো সাধারণ মানুষ হিসেবে এক টুকরি নিয়েছি, আরেক টুকরি নিতে হচ্ছে আমার নেতৃত্বের দায়িত্ব হিসেবে।’ অবশেষে প্রিয়নবীর পবিত্র মাথায় আরেক টুকরি মাটি তুলেই দিতে হলো।
এভাবে নেতা-কর্মীর মাঝে সমতা রক্ষা করে আদর্শ নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সাধারণত নেতৃত্বস্থানীয় লোকেরা সাধারণ কর্মীদের মতো কাজ করতে ইতস্তত বোধ করেন। মর্যাদা কমে যাবে ভাবেন। কিন্তু দোজাহানের বাদশা হযরত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ভাবেননি কখনও। তিনি নিজে কর্মীদের চেয়ে অধিক পরিশ্রম করে আদর্শ নেতৃত্বের শিক্ষা রেখে গেছেন। সেই নেতৃত্বের অনুসরণ আজও আমাদের মাঝে কল্যাণের প্রবাহ ঘটাতে সক্ষম।
সাদাসিধে জীবনযাপন
১. রহমাতুল্লিল আলামীনের বিছানা ছিলো খেজুর পাতার চাটাই। একদিন ঘুম থেকে জেগেছেন। কাছেই ছিলেন প্রিয় সাহাবী উমর রা.। তিনি চেয়ে দেখেন নবীজীর সারা পিঠে খেজুরপাতার দাগ পড়ে আছে। দোজাহানের স¤্রাট আখেরি নবী, সাইয়্যেদুল মুরসালীন এতো কষ্টে জীবনযাপন করবেন! প্রিয়নবীর জন্য একটু কোমল বিছানা তৈরির অনুমতি চাইলেন উমর রা. কিন্তু সাইয়্যেদুল মুরসালীন এই বলে বারণ করলেন যে, আল্লাহর নিকট ইহজীবনের কোনো মূল্য নেই। [পরকালের জীবনই হলো আসল জীবন।]
এ হলো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের সাদাসিধে জীবনযাপনের একটি দৃষ্টান্ত।
আজকের পৃথিবীতে আমাদের কাছে এসব কথা গল্পের মতোই মনে হবে। কারণ এ যুগের ক্ষমতাশীল ও তাঁদের পরিবারবর্গের পক্ষে এসব বিষয়ের কল্পনাও বোধ হয় কষ্টকর কামনা। আল্লাহ আমাদের সুমতি দান করুন।
জীবজন্তুর প্রতি দয়া
১. একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক আনসারীর বাগানে প্রবেশ করলেন। সেখানে একটি উট বাঁধা ছিলো। উটটির প্রতি নবীজীর চোখ পড়তেই উটটি ব্যাকুল হয়ে উঠলো এবং চোখেমুখে ওর এক করুণ অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটটির ব্যথায় ব্যথিত হয়ে ওর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। উটটি শান্ত হয়ে গেলো। নবীজী তখন আওয়াজ দিয়ে বললেন, এই উটটি কার? এক আনসারী যুবক এসে বললো, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, উটটি আমার।’ প্রিয়নবী তাকে বললেন, ‘এই বাকশক্তিহীন প্রাণীটির ব্যাপারে [আল্লাহ তোমাকে যার মালিক বানিয়েছেন] আল্লাহকে ভয় করো না? এই যে প্রাণীটি আমার কাছে অভিযোগ করেছে, তুমি তাকে অনাহারে রাখো এবং কঠিন কঠিন কাজ করিয়ে তাকে ক্লান্ত বানিয়ে দাও।’
২. আরেক দিনের ঘটনা। কোনো এক সফরে পথিমধ্যে কোথাও যাত্রাবিরতি করলেন। তারপর কোনো প্রয়োজনে অবস্থানস্থল হতে একটু দূরে গেলেন। এসে দেখেন এক সাহাবী এমন স্থানে চুলা জ্বালিয়েছেন যেখানে মাটির ভেতর পিপীলিকার গর্ত ছিলো। দেখে মহনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্ন করলেন, ‘কে করেছে এই কাজ?’ উক্ত সাহাবী আরজ করলেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি করেছি।’ নবীজী ইরশাদ করলেন, ‘চুলাটা নেভাও। এতে পিঁপড়াগুলোর কষ্ট হয়।’
এ হলো জীবজন্তুর প্রতি মহানবীর মমতার ছোট্ট দু’টি নজির। অনেকে মনে করেন যে, দয়ামায়া শুধু মানুষের জন্যই। জীবজন্তুর প্রতি আবার কিসের দয়া! এ ধারণা যে নিতান্তই দুঃখপ্রদ ও ভ্রম তা বলাই বাহুল্য।
আল্লাহর সকল মাখলুকের প্রতিই যে দয়াদ্র আচরণ করতে হবে আল্লাহর নবী আমাদেরকে তা শিখিয়ে দিলেন।
সওয়ারি ও মালবাহী জীবজন্তুর ব্যাপারে নির্দেশ হলোÑ এদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানো যাবে না, অনর্থক কষ্ট দেয়া যাবে না। গৃহপালিত পশুর ব্যাপারে নির্দেশ হলো, ঠিকমত তাদের পানাহার দিতে হবে। যেসব প্রাণী জবাই করে খাওয়া হয় তাদের ব্যাপারে নির্দেশ হলো যথাসম্ভব কম কষ্ট দিয়ে জবাই করতে হবে।
হযরত আব্বাস রা. বর্ণনা বরেন যে, একবার এক ব্যক্তি জবাই করার জন্য একটি প্রাণী শুইয়ে রেখে তাঁর ছুরিতে ধার দিচ্ছিলো। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দৃশ্য দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন। কাছে গিয়ে ইরশাদ করলেন, ‘তুমি কি প্রাণীটিকে দুইবার জবাই করতে চাও? ওকে শোয়ানোর পূর্বে ছুরি ধারিয়ে নিলে না কেনো?’
মানুষ বাকশক্তিহীন জীবজন্তুর প্রতি কী অত্যাচারই না চালিয়ে থাকে! সামান্য অপরাধেই জীবজন্তুকে নির্মমভাবে পেটায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবজন্তুর প্রতি কতো দয়াশীল ছিলেন উল্লিখিত ঘটনাগুলোর মাধ্যমে আমরা তা অনুমান করতে পারি। এসব জেনে শুধু জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করাই যথেষ্ট নয় বরং এসব থেকে বাস্তব শিক্ষা নিয়ে আমাদের জীবজন্তুর সাথে নরম আচরণ করতে হবে, অন্যথায় কেয়ামতের দিন অবশ্যই আমাদেরকে জবাবাদিহি করতে হবে।
শিশুদের প্রতি ¯েœহ-মমতা
১. একবার সাহাবী খালিদ ইবনে সাঈদ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন। সাথে তাঁর ছোট্ট মেয়েটি। লাল জামা পরিহিতা মেয়টিকে বাহবা দিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ছানাহ! ছানাহ!’ মানে সুন্দর সুন্দর। হাবশী ভাষায় ছানাহ মানে সুন্দর। মেয়েটির জন্ম হাবশায় [আফ্রিকা] হয়েছিলো। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সামঞ্জস্যে তাকে হাবশী ভাষায় সুন্দর সুন্দর বলে আনন্দ পেলেন।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে ছোট্ট মেয়েটি প্রিয়নবীর পৃষ্ঠদেশে শোভমান কবুতরের ডিম্বসদৃশ মহরে নবুওয়ত দেখতে পেলো। শিশুরা কৌতূহলী হয়ে থাকে। অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলে তা নিয়ে খেলা শুরু করে। এ মেয়েটিও তাই করলো। সে নবীজীর প্রবিত্র মুহরে নবুওয়ত নিয়ে খেলতে শুরু করলো। খালিদ রা. তাকে ধমক দিলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ধমকাতে বারণ করে বললেন, ‘আহা, ওকে খেলতে দাও।’
২. একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ আদরের দৌহিত্র হুসাইন রা. লাল জামা পরিধান করে ধীরে ধীরে তাঁর কাছে চলে এলো। নিতান্তই অল্পবয়সী হওয়ার কারণে কাঁপাকাঁপা পায়ে হাঁটছিলো সে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদরের আতিশয্যে মিম্বর থেকে নেমে এলেন। আদরের হুসাইনকে কোলে তুলে নিয়ে ইরশাদ করলেন, ‘আল্লাহ ঠিকই বলেছেন, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ।’
আরেক দিন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসান ইবনে আলী রা.-কে ডাকলেন। হাসান দৌড়ে এসে কোলে চড়ে বসলো। এরপর প্রিয় নানার দাড়ি মুবারকে অঙ্গলি ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে খেলা করতে লাগলো। মহানবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পর্যায়ে তাঁর পবিত্র মুখ খুলে দিলেন। হাসান পরমানন্দে এবার মুখের ভেতরে অঙ্গুলি ঢুকিয়ে খেলা করতে লাগলো।
উল্লেখ্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর-¯েœহ শুধু মুসলমান শিশুদের জন্য ছিলো না। তিনি বিধর্মী শিশুদের প্রতিও ¯েœহশীল ছিলেন। তিনি বলতেন যে, প্রত্যেক শিশুই আল্লাহর স্বভাবধর্মের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তারপর পিতামাতা তাকে ইহুদি নাসারা ও অগ্নিপূজক বানায়।
জীবনের প্রতিটি অঙ্গনেই আমরা খুঁজে পাই প্রিয়নবীর মানবিকতার অতুলনীয় আদর্শ। যে আদর্শে আমাদের ইহকাল ও পরকালের শান্তি ও সাফল্য নিহিত। প্রিয় পাঠক, তাই আসুন আমরা আন্তরিক আগ্রহে প্রিয়নবীর পবিত্র সীরাত পাঠ করি এবং আমাদের প্রতিদিনের জীবনে তা প্রতিফলিত করি।
তত্বসূত্র :
১  বুখারী শরীফ, ১ম খ., পৃষ্ঠা-৫৫৪
২  আখলাতে নবী ওয়াকেয়াতকে আয়নাহ মে, মাওলানা হিফযুর রহমান কাশেমী রহ.
৩  আখলাকে নববী, পৃষ্ঠা-১২৩
৪  সীরাতুন নবী, আল্লামা শিবলী নোমানী রহ.।
৫. আবু দাউদ, কিতাবুল আদব।
৬. মিশকাত শরীফ।

অধ্যায়-৩: কিয়ামতের দিন সম্বন্ধে ইসলামের দৃষ্টিভংগী

অধ্যায়-৩: কিয়ামতের দিন সম্বন্ধে ইসলামের দৃষ্টিভংগী

মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন যে, ইহকালীন জীবন পরকালীন জীবনের একটি প্রস্তুতি। দুনিয়ার এ জীবন আখেরাতের জীবনের পরীক্ষাকেন্দ্র। বিশ্বজগত ধ্বংসের পরে এই দিনটি আগমন করবে। মৃতব্যক্তিদেরকে আল্লাহর সামনে হিসাব-নিকাশের জন্য উত্থিত করা হবে। এ দিনটি হবে একটি নতুন জীবনের শুরু যার কোন শেষ নেই। এ দিনকেই বলা হয় কিয়ামতের দিন।
প্রত্যেক মানুষ তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস ও কর্মফলের মুখোমুখি হবে। যারা “ لا إله إلا الله محمد رسول الله ” (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ) তে বিশ্বাস করে মারা গেছে তারা মুসলমান। তারা তাদের কর্মফল হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (82)
অর্থাৎ, আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তারা হবে জান্নাতী। সেখানে তারা চিরস্থায়ী অবস্থান করবে। (সুরা বাকারা: ৮২)
আর যারা  ” لا إله إلا الله محمد رسول الله ” (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ) তে বিশ্বাস স্থাপন না করে মারা যাবে তারা মুসলমান বলে গণ্য হবে না। তারা চিরদিনের জন্য জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ (85)
অর্থাৎ, আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কিছুকে ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করবে তা কস্মিনকালেও গ্রহণযোগ্য হবে না। আর পরকালে সে হবে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা আলে ইমরান:৮৫)
তিনি আরও বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِمْ مِلْءُ الْأَرْضِ ذَهَبًا وَلَوِ افْتَدَى بِهِ أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ (91)
অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে এবং কুফরী অবস্থায় মারা গেছে তারা যদি আজাবের বিনিময়ে সারা পৃথিবী পরিমাণ স্বর্ণও দেয় তবুও তা গ্রহণ করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই। (সুরা আলে ইমরান: ৯১)
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে- আমি ধারণা করি যে,ইসলাম উত্তম ধর্ম; আমি যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি তাহলে,পরিবার-পরিজন,বন্ধুবান্ধব,ও অন্যান্য লোকেরা আমার উপর অত্যাচার নির্যাতন ও ঠাট্টা বিদ্রুপ করবে। তাহলে,আমি যদি ইসলাম গ্রহণ করি দোযখ বা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব?
এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে-আমরা পবিত্র কুরআন মাজীদে দেখতে পাই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ (85)
অর্থাৎ, আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কিছুকে ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করবে তা কস্মিনকালেও গ্রহণযোগ্য হবে না। আর পরকালে সে হবে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা আলে ইমরান:৮৫)
আল্লাহ তায়ালা রাসুল হিসেবে মুহাম্মদ (সাঃ)কে প্রেরণ করার পরে কেউ নিজেকে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের সাথে সম্পৃক্ততা দেখালে আল্লাহ তায়ালা তা গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টিকর্তা,ও অভিভাবক। তিনি দুনিয়ার সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের যতসব কল্যাণ, দয়া-মায়া,মমতা সবকিছুই তার কাছ থেকে এসেছে। এসবের পরেও যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ঈমান আনবে না এবং তার মনোনীত ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা ইসলামকে মেনে নেবে না তাকে পরকালে শাস্তি দেয়াই ন্যায়পরায়ণতার কাজ। তবে,ইহকালে আমাদেরকে সৃষ্টির মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে একক সত্ত্বা আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত বা আনুগত্য করা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ (56)
অর্থাৎ,আমি মানুষ ও জ্বীনজাতিকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদাতের জন্য।(সুরা যারিয়াত:৫৬)
আমরা যেখানে বসবাস করছি তা খুবই সংক্ষিপ্ত জীবন। কিয়ামতের দিনে কাফেররা বিশ্বাস করবে যে,তারা দুনিয়ায় বসবাস করেছে শুধুমাত্র একদিন বা তার কিছু অংশ। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ (112) قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ (113)
অর্থাৎ,আল্লাহ তায়ালা বলবেন:তোমরা বছরের গণনায় পৃথিবীতে কতদিন অবস্থান করেছিলে? তারা বলবে-আমরা একদিন বা তার কিছু অংশ পৃথিবীতে অবস্থান করেছিলাম। অতএব,গণনাকারীদেরকে জিজ্ঞাসা করুন। (সুরা মু’মিনুন:১১২-১১৩)
আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন:
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ (115) فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ (116)
অর্থাৎ,তোমরা কি মনে করেছ যে,আমি তোমাদেরকে অযথাই সৃষ্টি করেছি এবং  তোমাদেরকে আমার দরবারে ফিরে আসতে হবে না? অতএব, শীর্ষ মহিয়ান আল্লাহ তায়ালা তিনিই সত্যিকার মালিক, তিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। তিনি সন্মানিত আরশের মালিক। (সুরা মু’মিনুন: ১১৫-১১৬)
পরকালের জীবনই আসল জীবন। সেটা শুধুমাত্র আত্মার জীবনই নয় বরং, তা শারিরীক জীবনও। আমরা সেখানে বসবাস করব আমাদের আত্মা ও শরীর উভয়টি নিয়েই। দুনিয়ার জীবনের সাথে আখেরাতের জীবনের তুলনা করতে গিয়ে রাসুল (সাঃ) বলেছেন-
وَاللَّهِ مَا الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ فِي الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ تَرْجِعُ إِلَيْهِ
অর্থাৎ, আল্লাহর কসম! কোন ব্যক্তি তার আঙ্গুলকে সমুদ্রের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়ার পর  (আঙ্গুল সরিয়ে নিলে) তার কাছে সমুদ্রের তুলনায় যতটুকু অংশ (পানি) আসে আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া তেমনই। (মুসলিম ও মুসনাদে আহমদ)
এমনিভাবে আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের মুল্য অথৈ সমুদ্রের তুলনায় কয়েক ফোটা পানির সমান ছাড়া আর কিছুই নয়।…

আল্লাহ্‌ থাকতে পৃথিবীতে এত দু:খ-কষ্ট কেন?

আল্লাহ্‌ থাকতে পৃথিবীতে এত দু:খ-কষ্ট কেন?

suffering of a child
প্রশ্ন ১আল্লাহ যদি সর্বশক্তিমান এবং পরম করুনাময় হন, তাহলে পৃথিবীতে এত দু:খ-কষ্ট কেন?
উত্তর: প্রথম কথা হলো, পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্ট থাকলেও পৃথিবীতে অনেক আনন্দও আছে। বরং, পৃথিবীতে আনন্দই বেশী, নাহলে অধিকাংশ মানুষ বেঁচে থাকতে চাইত না।
বলুন, আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সব সুশোভন বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে নিষিদ্ধ করেছে? বলুন, এসব তো ঈমানদারদের জন্য পার্থিব জীবনে এবং বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে। – সূরা আরাফ(৭:৩২)
দ্বিতীয়ত: অনেক সময় এমন কিছু হয় যা আপনার কাছে আপাতঃদৃষ্টিতে কষ্টদায়ক বলে মনে হয়, কিন্তু পরে যেয়ে দেখা যায় ঐ কষ্টের ঘটনাটার জন্যই আপনার জীবনে এমন কোন পরিবর্তন এসেছে যা আপনার জন্য অনেক বেশী উপকারী। আমাদের সবার জীবনেই কম-বেশী এরকম অভিজ্ঞতা আছে। এভাবে, আল্লাহ্‌ আমাদের বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেন, যাতে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি এবং কঠিনতর পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি।
তিনি (আল্লাহ্) বললেন: আমি যা জানি তোমরা তা জান না।  (সূরা বাক্বারাহ্‌ ২:৩০)।
তৃতীয়ত: এই পৃথিবীটা হলো একটা পরীক্ষার জায়গা। আল্লাহ্‌ বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করছেন। এই পরীক্ষা আনন্দদায়ক হতে পারে, আবার কষ্টেরও হতে পারে। যেমন, আপনার যদি অনেক টাকা-পয়সা থাকে তাহলে আল্লাহ্‌ আপনাকে সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করছেন, যে আপনি সেই সম্পদ কিভাবে ব্যয় করবেন। আপনার যদি অনেক মেধা থাকে, তো আল্লাহ্‌ আপনাকে পরীক্ষা করছেন আপনি কিভাবে সেই মেধাকে ব্যবহার করেন।  অন্যদিকে, আপনার বা আপনার সন্তানের যখন কোন অসুখ হয় তখন আল্লাহ্‌ আপনার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেন। আপনার ভাই-বোন বা পরিচিত কেউ যখন কোন বিপদে পড়ে তখনও আপনার পরীক্ষা হয় আপনি তাকে কিভাবে কতটুকু সাহায্য করছেন। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোরআন-উল-কারীমে বলেন:
নিশ্চয়ই আমি তোমাদের (কাউকে) ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে, আর (কাউকে) ধনেপ্রাণে বা ফলফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করব। আর যারা ধৈর্য ধরে তাদের তুমি সুখবর দাও। (তারাই ধৈর্যশীল) যাদের ওপর কোন বিপদ এলে বলে, ‘(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি’উন, অর্থাৎ) নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তারই দিকে ফিরে যাব’। এদের উপর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে শান্তি ও করুণা বর্ষিত হয় এবং এরাই সুপথগামী।  -সূরা বাক্বারাহ্‌  (২:১৫৫-১৫৭)
আপনি যখন কোন পরীক্ষা দিতে বসেন, আপনার শিক্ষক যেমন কিছু সহজ প্রশ্ন দেন, আবার কিছু কঠিন প্রশ্নও দেন, আল্লাহ্‌ও তেমনি মানুষকে পরীক্ষা করেন বিভিন্ন আনন্দদায়ক ও দু:খজনক ঘটনার মাধ্যমে। এই জীবন শুধুই একটা পরীক্ষাকেন্দ্র, পরকালের জীবনই আসল জীবন।
আর পার্থিব জীবন তো ক্রীড়াকৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয়; আর সাবধানীদের জন্য পরকালের আবাসই ভালো; তোমরা কি বোঝ না? – (সূরা আন’আম  ৬:৩২)
চতুর্থত: আল্লাহ্‌ তাঁর করুণার মাত্র ১ ভাগ পৃথিবী আর তার সমস্ত কিছুর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বাকী ৯৯ ভাগ তিনি তাঁর কাছে রেখে দিয়েছেন যা দিয়ে তিনি কিয়ামতের দিন তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে করুণা করবেন (সহীহ্‌ বুখারী)।
আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের প্রতি কি পরিমান ক্ষমাশীল ও করুণাময় নিচের হাদিস থেকে তার কিছু নমুনা পাওয়া যায়।
রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর নিযুক্ত ফেরেশতাদের নির্দেশ করলেন তোমাদের ভাল ও মন্দ কাজ লিখে রাখতে, আর এরপর তিনি শিখিয়ে দিলেন কিভাবে লিখতে হবে। কেউ যদি কোন ভাল কাজ করার নিয়ত করে এবং এরপর কাজটি না করে, আল্লাহ্‌র তার জন্য একটি পূর্ণ ভাল কাজের নেকী লিখে রাখেন। কেউ যদি কোন ভাল কাজ করার নিয়ত করে এবং এরপর কাজটি বাস্তবায়িত করে, আল্লাহ্‌র তার জন্য ঐ কাজটির যা নেকী তা ১০ থেকে ৭০০ গুণ, এমন কি এর চেয়েও বহু গুণে বৃদ্ধি করে লিখে রাখেন। অন্যদিকে, কেউ যদি কোন খারাপ কাজ করার নিয়ত করে এবং এরপর কাজটি না করে, আল্লাহ্‌র তার জন্য একটা পূর্ণ ভাল কাজের নেকী লিখে রাখেন। আর কেউ যদি কোন খারাপ কাজ করার নিয়ত করে এবং এরপর কাজটি বাস্তবায়িত করে, আল্লাহ্‌র তার জন্য একটি মাত্র গুনাহ্‌ লিখে রাখেন। (সহীহ্‌ বুখারী)
প্রশ্ন ২। তারপরো আমি কিছু ব্যাপার মেনে নিতে পারছি না। এই যেমন, কত ছোট্ট শিশুর ক্যান্সার হয়, অথবা বিল্ডিং ধসে অনেক নিরীহ মানুষ মারা যায়, কিংবা সুনামিতে কত নিষ্পাপ শিশু মারা যায় – আল্লাহ্‌ থাকতে এগুলো হয় কিভাবে? আল্লাহ্‌ কেন ওদেরকে বাঁচান না?
উত্তর: এরকম কেন ঘটে তা তিনটি কারণ/উদাহরন দিয়ে বুঝাচ্ছি।
এক –  আমরা মনে করি মারাত্মক কোনও অসুখ বা মৃত্যু মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি – এই ধারণা ঠিক না। মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো জাহান্নামে নিক্ষেপিত হওয়া, আর তাই আল্লাহ্‌ আমাদের বিভিন্ন কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে সামগ্রিকভাবে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ করে দেন। আল্লাহ্‌ হয়ত কারো শিশু সন্তানকে ক্যান্সার এই কারণে দিয়েছেন যে এই সন্তানটি বড় হলে খুব খারাপ মানুষ হয়ে নিজের বাবা-মা সহ অনেক মানুষের ক্ষতি করতো। সূরা কাহফে মুসা(আ) ও খিজির(আ) এর কাহিনীতে আল্লাহ্‌ এইরকম একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
ঠিক যেমন আপনি যখন আপনার বাচ্চাটিকে টীকা দিতে নিয়ে যান সে কিন্তু অনেক কাঁদতে থাকে, তাও আপনি তাকে জোর করে টীকা দেওয়ান, এমনকি তার জ্বর হতে পারে এটা জানার পরেও আপনি ডাক্তারকে টীকা দিতে বলেন। কেন বলেন? কারণ, আপনি জানেন এই সাময়িক যন্ত্রনা তাকে সারাজীবনের জন্য রোগমুক্ত করবে। একই কারণে, আল্লাহ্‌ আমাদের উপর বিভিন্ন বিপদ দেন, বিপদের মাধ্যমে তিনি আমাদের গুনাহ মাফ করেন এবং চিরস্থায়ী জান্নাতের জন্য উপযুক্ত করেন।
দুই – আল্লাহ্‌ অনেক সময় সুনামী, বন্যাসহ নানা দুর্যোগ পাঠিয়ে থাকেন মানুষের অর্জিত পাপের শাস্তি প্রদান করার জন্য এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ্‌ পাপী জাতিকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করেন, যেমন করেছেন নূহ(আ), লুত(আ) এর সম্প্রদায়কে, আদ জাতিকে, সামুদ জাতিকে। (বিস্তারিত পড়ুন আমার এই লেখায়)
তিন -  আমরা শুধু ব্যক্তিগত মঙ্গলের কথা চিন্তা করি, আল্লাহ্‌ চিন্তা করেন সামগ্রিক মঙ্গলের কথা। আগেই বলেছি আল্লাহ্‌ ভবিষ্যৎ জানেন, আমরা জানি না (সূরা বাক্বারাহ্‌ ২:৩০)। আমার কাছে সাময়িক ভাবে যেটা বেদনাদায়ক মনে হয়, সেটা হয়তো আল্লাহ্‌ সামগ্রিকভাবে মানবজাতির মঙ্গলের জন্য করছেন।
যখন কোথাও সুনামী হয়, অনেক মানুষ মারা যায়, তখন যাদের মধ্যে ঈমানের ছিটে ফোঁটাও আছে তার অনুধাবন করতে পারে যে এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, এর পেছনে ছুটা নিরর্থক, পাথেয় সঞ্চয় করতে হবে পরকালের। এভাবে এক এলাকার মানুষকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ অন্য এলাকার মানুষদের শিক্ষাও দিতে পারেন। আবার, যে শিশুটি বড় হয়ে পাপ কাজ করে জাহান্নামে যেতো, শিশু বয়সেই সুনামীতে তার মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ্‌ হয়ত তাকে জান্নাতের জন্য উপযুক্ত করেছেন!  জান্নাত পেলে আমরা পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে যেয়ে শুধুই আল্লাহর প্রশংসা করব, অন্যদিকে যে জাহান্নামী হবে তার কাছে পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ-উল্লাসই তুচ্ছ মনে হবে!
আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন যে, পুনরুত্থানের দিন এমন একজন ব্যক্তিকে আনা হবে যে পৃথিবীতে আরাম-আয়েশ এবং প্রাচুর্যতার মধ্যে জীবন কাটিয়েছিল কিন্তু এখন সে জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। এই লোকটিকে একবার মাত্র জাহান্নামের আগুনে ডুবানো হবে এবং জিজ্ঞেস করা হবে: হে আদমসন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কোনও শান্তি বা কোনও সম্পদ পেয়েছিলে? সে উত্তর দিবে: আল্লাহর কসম! না, ও আমার রব!
এবং এরপর এমন একজন ব্যক্তিকে আনা হবে যে জান্নাতের বাসিন্দা কিন্তু সে পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছিলো। এই লোকটিকে জান্নাতে একবার মাত্র ডুবানো হবে এবং তাকে জিজ্ঞেস করা হবে: হে আদমসন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কোনও কষ্টের মধ্যে ছিলে? সে বলবে: আল্লাহর কসম! না, ও আমার রব! আমি দুনিয়াতে কখনোই কোনো কষ্টের সম্মুখীন হইনি বা কোনো দুর্দশায় পড়িনি। – (সহীহ মুসলিম)
References:
1. Why does God permit suffering on earth – Abdur Raheem Green
2. Understanding Tragedies and Calamities – Dr. Yasir Qadhi

আখিরাতের জীবন চিত্র

আখিরাতের জীবন চিত্র প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী   
আর্টিকেল সূচি
আখিরাতের জীবন চিত্র
আখিরাতের জীবন পূর্ব নির্ধারিত
মানুষ কর্মফল অনুসারে তিন দলে বিভক্ত হবে
জাহান্নামের ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর

আখিরাতের জীবন চিত্র



যা বলতে চেয়েছি

মানুষ মৃত্যুর পরের জীবন তথা বিচার দিবস সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে, এ জন্য আল্লাহ তা’য়ালা পৃথিবীতেই মৃত্যুর পরে জীবনদানের প্রক্রিয়া সংঘটিত করেছেন, যেন মানুষের মনে কোন ধরনের সন্দেহ-সংশয় দানা বাঁধতে না পারে। অস্তিত্বহীন মানুষকে তিনি অস্তিত্ব দান করেছেন, আবার তিনিই তাকে মৃত্যুদান করবেন। আবার তিনিই পুনরায় জীবনদান করে বিচার দিবসে একত্রিত করবেন। কিভাবে করবেন, তিনি তা মানুষকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দিয়েছেন। পৃথিবীতে মানুষের চোখের সামনে মৃত জিনিসগুলোকে পুনরায় জীবনদান করে মানুষকে দেখানো হয়, এভাবেই তিনি বিচার দিবসে মানুষকে পুনরায় জীবনদান করবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কর্মগুলোকে শক্তিমত্তার দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মন সাক্ষী দেয় যে, তিনি যখনই ইচ্ছা করবেন, তখনই সমস্ত মৃতকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম। ইতোপূর্বে যাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না, তাদেরকে তিনি অস্তিত্ব দান করেছেন। অপরদিকে আল্লাহর কাজগুলোকে যদি তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে বুদ্ধিবৃত্তি সাক্ষী দেয় যে, তিনি মানুষকে পুনরায় জীবনদান করে হিসাব গ্রহণ করবেন।
বর্তমান কালে যেমন কিছু সংখ্যক মানুষ ধারণা করে, পৃথিবীর এই জীবনই শেষ জীবন। পুনরায় আর জীবন লাভ করা যাবে না তথা পরকাল বলে কিছু নেই। এই ধারণা নতুন কিছু নয়- একই ধরনের ধারণা সুদূর অতীত কাল থেকেই এক শ্রেণীর ভোগবাদী পরকাল অবিশ্বাসী মানুষ পোষণ করে আসছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সময়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সে সময়েও মানুষের ধারণা ছিল, মানুষকে পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মানুষ এখানে যা ইচ্ছে তাই করবে। এমন কোন উচ্চশক্তির অস্তিত্ব নেই, যার কাছে মানুষ তার যাবতীয় কর্মকান্ডের হিসাব দিতে বাধ্য। মৃত্যুর পরে আর কোন জীবন নেই। পৃথিবীতে সংঘটিত কোন কর্মকান্ডের হিসাব কারো কাছেই দিতে হবে না। এই ধারণা মারাত্মক ভুল। পরকাল অবশ্যই সংঘটিত হবে এবং সেদিন সকল কাজের জবাবদিহি মহান আল্লাহর কাছে করতে হবে। পরকালে জবাবদিহির অনুভূতি ব্যতীত মানুষ কোনোক্রমেই পৃথিবীতে সৎ-চরিত্রবান হতে পারে না। এ জন্য পবিত্র কোরআন-হাদীসে পরকালের বিষয়টি সর্বাধিক আলোচিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলের হৃদয়ে পরকালে জবাবদিহির অনুভূতি সজাগ করে দিন।
মহান আল্লাহর অনুগ্রহের একান্ত মুখাপেক্ষী
-সাঈদী

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

পরকালীন জীবনের প্রয়োজনীয়তা

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবীকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। পৃথিবী ও আকাশ এবং এর মধ্যস্থিত কোন কিছুই নিছক খেয়ালের বশে সৃষ্টি করা হয়নি। তাঁর এই সৃষ্টি কোন শিশুর খেলনার মতো নয়। শিশুদের মতো মনের সান্ত্বনা লাভ ও মন ভুলানোর জন্য কোন খেলনার মতো করে এই পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়নি যে, শিশু কিছুক্ষণ খেলে তৃপ্তি লাভ করার পরে উদ্দেশ্যহীনভাবে একে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল অথবা অবহেলা আর অনাদরে রেখে দিল বা ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে দিল। নিজের দেহ থেকে শুরু করে আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টির প্রতি সাধারণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই এমন ধারণা করার কোন অবকাশ থাকে না। বরং তাঁর এ সৃষ্টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, ঐকান্তিকতা ও বুদ্ধিমত্তার ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, এ কথা দিবালোকের মতই স্পষ্ট হয়ে যায়।
সমগ্র সৃষ্টির প্রতিটি পরতে পরতে বিরাট উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে এবং এর প্রতিটি অধ্যায়ে লক্ষ্যও স্থির করা হয়েছে। সৃষ্টির অভ্যন্তরীণ একটি পর্যায় সমাপ্ত ও অতিবাহিত হবার পরে আল্লাহ তা’য়ালা নিশ্চিতভাবে যাবতীয় কার্যের হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করবেন এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী অধ্যায় রচিত করবেন। তিনি সমগ্র সৃষ্টিসমূহকে মহাসত্যের সুদৃঢ় ভিত্তির ওপরে সংস্থাপিত করেছেন। সৃষ্টির প্রতিটি দিক ন্যায়বিচার, সত্যতার নিময়-নীতি ও বিচক্ষণতার ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। দৃশ্য-অদৃশ্য সমস্ত কিছুর বাদশাহী একমাত্র তাঁরই এবং তিনি যখন ইচ্ছা পোষণ করবেন, তখনই আদেশ দানমাত্র সৃষ্টির প্রতিটি অনু-পরমাণু তাঁর দরবারে উপস্থিত হতে বাধ্য। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
তিনিই আকাশ ও যমীনকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং যেদিন তিনি বলবেন, হাশর হও, সেদিনই হাশর হবে। তাঁর কথা সর্বাত্মকভাবে সত্য এবং যেদিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, সেদিন নিরঙ্কুশ বাদশাহী তাঁরই হবে। গোপন ও প্রকাশ্য সমস্ত কিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতায়, তিনি অত্যন্ত সুবিজ্ঞ, সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত। (সূরা আনআম-৭৩)
সৃষ্টিজগতে সাধারণ মানুষ চর্মচোখে যা কিছু দেখতে পাচ্ছে এবং বিজ্ঞানীগণ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে যা কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন, সবকিছুর ভেতরে প্রতিনিয়ত একটি পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পরিবর্তন সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। ঊর্ধ্বজগত ক্রমশঃ সম্প্রসারিত হচ্ছে। সৃষ্টির নিপুণতা ও বিজ্ঞ-কৌশলীর নান্দনিক নির্মাণ শৈলী দেখে এ কথা ভাবার কোন যুক্তি নেই যে, এসব কিছু শিশুর খেলার ছলে সৃষ্টি করা হয়েছে।
বরং সৃষ্টিসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টির ব্যাপারে গভীর উদ্দেশ্যবাদের স্পষ্ট চিহ্ন বিদ্যমান দেখা যায়। সুতরাং, স্রষ্টাকে যখন বিজ্ঞানী, যুক্তিবাদী বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে এবং তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার স্পষ্ট নিদর্শন মানুষের সামনে বিরাজমান, তখন তিনি মানুষকে জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি, নৈতিক চেতনা, স্বাধীন দায়িত্ব ও প্রয়োগ-ক্ষমতা দেয়ার পর তার জীবনে কৃত ও সংঘটিত কার্যাবলীর কোন হিসাব গ্রহণ করা হবে না এবং বিবেক ও নৈতিক দায়িত্বের ভিত্তিতে শাস্তি ও পুরস্কার লাভের যে অধিকার অনিবার্যভাবে জন্মে থাকে, তা স্রষ্টা নিষ্ফল ও ব্যর্থ করে দিবেন এ ধারণার কোন সত্যনিষ্ঠ ভিত্তি থাকতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আল্লাহ তা’য়ালা এসব কিছুই স্পষ্ট উদ্দেশ্য সম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা ইউনুস-৫)
বর্তমান কালে যেমন কিছু সংখ্যক মানুষ ধারণা করে, পৃথিবীর এই জীবনই শেষ জীবন। পুনরায় আর জীবন লাভ করা যাবে না তথা পরকাল বলে কিছু নেই। এই ধারণা নতুন কিছু নয়- একই ধরনের ধারণা সুদূর অতীত কাল থেকেই এক শ্রেণীর ভোগবাদী পরকাল অবিশ্বাসী মানুষ পোষণ করে আসছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সময়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সে সময়েও মানুষের ধারণা ছিল, মানুষকে পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মানুষ এখানে যা ইচ্ছো তাই করবে। এমন কোন উচ্চশক্তির অস্তিত্ব নেই, যার কাছে মানুষ তার যাবতীয় কর্মকান্ডের হিসাব দিতে বাধ্য। জীবন একটিই- সুতরাং যা খুশী, যেমনভাবে খুশী জীবনকে ভোগ করতে হবে। মৃত্যুর পরে আর কোন দ্বিতীয় জীবন নেই। পৃথিবীতে সংঘটিত কোন কর্মকান্ডের হিসাব কারো কাছেই দিতে হবে না।
অতএব জীবনকালে সম্পাদিত কোন কাজের জন্য কোন শাস্তি ও পুরস্কার লাভের কোন প্রশ্নই আসে না। জীবন সৃষ্টিই হয়েছে ভোগ করার জন্য। অতএব জীবনকে কানায় কানায় ভোগ করতে হবে। তারপর একদিন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।
এদের ধারণা হলো, পৃথিবী হলো দৃশ্যমান। এর অস্তিত্ব চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। অতএব এটাকেই যে কোন প্রক্রিয়ায় ভোগ করতে হবে। আর পরকালের বিষয়টি হলো বাকি। সেটা হবে কি হবে না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। যে বিষয়টি সংশয়পূর্ণ, সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে পৃথিবীর ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকা সম্পূর্ণ বোকামী। বহুদূর থেকে যে বাদ্য ঝংকার ভেসে আসছে, তা শোনার মধ্যে কোন তৃপ্তি নেই। চাক্ষুষ দর্শনের ভিত্তিতে যে হৃদয়গ্রাহী মনমাতানো বাদ্য ঝংকার উপভোগ করা যায়, তার ভেতরেই রয়েছে পরিপূর্ণ তৃপ্তি। পরকালে অবিশ্বাসী এসব ধারণা ও চিন্তা-চেতনা প্রকৃতপক্ষে এ কথাই ব্যক্ত করে যে, বিশ্ব জগতের সমগ্র ব্যবস্থা নিছক একজন খেলোয়াড়ের খেলা ব্যতিত আর কিছুই নয়। কোন গুরুগম্ভীর ও পরিকল্পনা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এই সৃষ্টিজগৎ পরিচালিত হচ্ছে না। এদের এই যুক্তিহীন ধারণার প্রতিবাদ করে মহান আল্লাহ বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এ আকাশ ও পৃথিবী এবং এদের মধ্যে যা কিছুই রয়েছে এগুলো আমি খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। যদি আমি কোন খেলনা সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক হতাম এবং এমনি ধরনের কিছু আমাকে করতে হতো তাহলে নিজেরই কাছ থেকে করে নিতাম। (সূরা আম্বিয়া)
মহান আল্লাহ বলেন, আমি খেলোয়াড় নই। খেল-তামাসা করা আমার কাজ নয়। আর এই পৃথিবী একটি বাস্তবানুগ ব্যবস্থা। কোন ধরনের মিথ্যা শক্তি পৃথিবীর মাটিতে টিকে থাকে না। মিথ্যা যখনই এই পৃথিবীতে স্বদম্ভে নিজের ক্ষয়িঞু অস্তিত্ব প্রকাশ করেছে, তখনই সত্যের সাথে তার অনিবার্য সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তা অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে। আমার পরিকল্পনা ভিত্তিক সৃষ্টি এই পৃথিবীকে তুমি খেলাঘর মনে করে জীবন পরিচালিত করো অথবা আমার বিধানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মতবাদ রচিত করে তার ভিত্তিতে নিজেদেরকে পরিচালিত করে থাকো, তাহাল এসবের পরিণতিতে তুমি নিজের ধ্বংসই ডেকে আনবে।
তোমার নিকট ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখো, আমার সৃষ্টিকে যারা খেলাঘর মনে করেছে, পৃথিবীকে যারা ভোগের সামগ্রীতে পরিপূর্ণ একটি বিশালাকারের থালা মনে করেছে, পৃথিবীকে যারা ভোগ-বিলাসের লীলাভূমি মনে করেছে, আমার ইসলামের সাথে যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের কি করুণ পরিণতি ঘটেছে, পৃথিবীটাকে ভ্রমণ করে দেখে নাও। তোমরা কি এ কথা মনে করেছো নাকি যে, তোমাদেরকে আমি এমনিই খেলাচ্ছলে আমোদ-আহ্লাদ করার জন্য সৃষ্টি করেছি? তোমাদের সৃষ্টির পেছনে কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই-নিছক একটি উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি হিসাবে বানিয়ে পৃথিবীতে তোমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছি, তোমাদের কোন কাজের হিসাব গ্রহণ করা হবে না, এ কথা ভেবেছো নাকি? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
তোমরা কি মনে করেছিলে আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের কখনো আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না ? (সূরা মু’মিনূন-১১৫)
গোটা বিশ্বের কোন একটি অণুও অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তা যথার্থ সত্যের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে এবং একটি দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনায় এটি পরিচালিত হচ্ছে। সমস্ত সৃষ্টির প্রতিটি অণু ও পরমাণু এই কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সমস্ত জিনিস পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সহকারে নির্মিত হয়েছে। গোটা সৃষ্টির ভেতরে একটি আইন সক্রিয় রয়েছে। দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সমস্ত কিছুই উদ্দেশ্যমূখী। মানব জাতির সমগ্র সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থব্যবস্থা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এই কথারই সাক্ষ্য প্রদান করছে যে, একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্রষ্টা সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের পেছনে সক্রিয় নিয়ম-নীতি উদ্‌ভাবন করে এবং প্রতিটি বস্তু যে উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে তা অনুসন্ধান করেই মানুষ এখানে এসব কিছু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। যদি একটি অনিয়মতান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টির মধ্যে একটি খেলনার মতো মানব জাতিকে রেখে দেয়া হতো, তাহলে তাদের পক্ষে কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা চিন্তাই করা যেত না।
অতএব যে অসীম বৈজ্ঞানিক সত্তা এমন প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্যমূখীতা সহকারে এই পৃথিবী নির্মাণ করেছেন এবং এর ভেতরে মানুষের মতো একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে যাবতীয় দিক দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক শক্তি, উদ্‌ভাবনী ক্ষমতা, ইচ্ছা ও স্বাধীন ক্ষমতা এবং নৈতিক অনুভূতি দিয়ে স্বীয় পৃথিবীর অসংখ্য উপকরণ মানুষের হাতে অর্পণ করেছেন, তিনি মানুষকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করতে পারেন, এমন কথা কি কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কল্পনা করতে পারে? মানুষ কি এ কথা মনে করেছে যে, তারা এই পৃথিবীতে ভাঙবে, গড়বে, অন্যায় কর্ম করবে, সৎ কর্ম করবে, ভোগ করবে, ত্যাগ করবে এরপর একদিন মৃত্যুবরণ করে মাটির সাথে মিশে যাবে- তারপর তোমরা যে কাজ করে গেলে, তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না, এটা কি করে কল্পনা করলে? তোমরা নানাজনে নানা ধরনের কাজ করবে, তোমাদের কোন কাজের প্রতিক্রিয়া হিসাবে তোমাদের মৃত্যুর পরও অসংখ্য নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকবে, তোমরা এমন একটি মতবাদ বা নিয়ম-নীতির প্রতিষ্ঠিতা করে যাবে, এর ফলে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে অরাজকতা চলতে থাকবে, মানুষ তার নিষ্ঠুর পরিণতি ভোগ করতে থাকবে, আর তোমাদের মৃত্যুর পরই এসব কর্মের হিসাব গ্রহণ না করে তা গুটিয়ে নিয়ে মহাশূন্যে নিক্ষেপ করা হবে, এ কথাই কি তোমরা কল্পনা করো? পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আমি আকাশ ও পৃথিবীকে এবং তাদের মাঝখানে যে জগৎ রয়েছে তাকে অনর্থক সৃষ্টি করিনি। (সূরা সা’দ-২৭)
সেই আদিকাল থেকেই পরকাল বা বিচার দিবসকে সামনে রেখে মানব সমাজ পরস্পর বিরোধী দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল মানুষ ভেবেছে পৃথিবীর জীবনই একমাত্র জীবন, মৃত্যুর পরে আর কিছুই নেই। আরেক দল যুক্তি প্রদর্শন করেছে, মানুষ পৃথিবীতে যা কিছুই করছে, এর পূর্ণাঙ্গ হিসাব দিতে হবে। পরকালের প্রতি যারা অবিশ্বাস পোষণ করে, তাদের কথার পেছনে যুক্তি একটিই রয়েছে, ‘পরকাল বলে কিছুই নেই’ এই কথাটি ব্যতীত দ্বিতীয় আর কোন যুক্তি তাদের কাছে নেই। আর পরকাল যে অবশ্যম্ভাবী, এ কথার পেছনে অসংখ্য যুক্তি-প্রমাণ বিদ্যমান।
সাধারণভাবে এই পৃথিবীতে সমস্ত মানুষের জীবন একইভাবে পরিচালিত হয় না। মানব সমাজে দেখা যাচ্ছে, কোন মানুষ তার গোটা জীবন ব্যাপীই অন্যের অবহেলা, অবজ্ঞা, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, অত্যাচার, শোষণ-নির্যাতন-নি্‌ৌ৬৩৭৪৩;ষণ সহ্য করে আসছে। প্রভাব-প্রতিপত্তি না থাকার কারণে তাকে এসব কিছু সহ্য করে একদিন মৃত্যুর কোলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হচ্ছে। এখানে ইনসাফের দাবি ছিল, ঐ ব্যক্তির প্রতি যে অন্যায়-অবিচার অন্য মানুষে করলো, তার সুষ্ঠু বিচার হওয়া। সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিতাবস্থায় সে পৃথিবীর বন্ধন ত্যাগ করলো। গোটা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে লোকটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে আগ্রহী হয়, তাহলে তা কখনোই সম্ভব হবে না। সুতরাং এখানে ইনসাফ দাবি করছে যে, মৃত্যুর পরে আরেকটি জগৎ থাকা উচিত। যে জগতে পৃথিবীতে অধিকার বঞ্চিত ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। একজন প্রভাব-প্রতিপত্তিশীল শক্তির অধিকারী নেতার ষড়যন্ত্রের কারণে গোটা জাতি অধিকার বঞ্চিত হয়, দেশের স্বাধীনতা হারিয়ে ভিন্ন জাতির গোলামী করতে বাধ্য হয়, ক্ষেত্র বিশেষে জাতীয় নেতৃবৃন্দের ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ অসহায় জনগণ প্রাণ দিতে বাধ্য হয় অথচ বাস্তবে দেখা গেল, সেই নেতার গোপন ষড়যন্ত্রের কথা কোনদিন প্রকাশিত হলো না এবং তার কোন বিচারও হলো না। একশ্রেণীর মানুষ সেই ষড়যন্ত্রকারী রক্ত লোলুপ হিংস্র নেতাকে দেবতার আসনে আসীন করে পূজা করলো। মৃত্যুর পরেও সেই নেতার মূর্তি নির্মাণ করে, প্রতিকৃতি বানিয়ে ফুল দিয়ে পূজা করতে থাকলো।
এ অবস্থায় জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি, ইনসাফ কি দাবি করে? দাবি তো এটাই করে যে, ষড়যন্ত্রকারী নেতার গোপন ষড়যন্ত্র জাতির সামনে প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল। তার ষড়যন্ত্রের কারণে জাতি পরাধীন জাতিতে পরিণত হলো, অসংখ্য মানুষ নির্মমভাবে নিহত হলো। এসব অপরাধের কারণে তাকে চরম দন্ডে দন্ডিত করা উচিত ছিল। কিন্তু সে দন্ড ভোগ করা তো দূরের কথা, জীবিতকালে বিপুল ঐশ্বর্যø আর ভোগ-বিলাসের মাধ্যম দিয়ে সে কানায় কানায় তার জীবনকে পূর্ণ করলো। তারপর মৃত্যুর পরেও তার দলের লোকজন তার সীমাহীন বিশ্বাসঘাতকতা আর ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ জাতির কাছে গোপন করে তার প্রতিকৃতি বেদীতে স্থাপন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পূজা করতে বাধ্য করলো।
এভাবে গোটা জাতিকেই ইনসাফ থেকে বঞ্চিত করা হলো এবং প্রকৃত অপরাধীকে দন্ড দানের পরিবর্তে আকাশ চুম্বী সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হলো। যদি বলা হয় যে, জাতীয় সেই নেতাকে চরম দন্ডদান করলেই তো জাতি ইনসাফ লাভ করলো। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কিভাবে সেই বিশ্বাসঘাতক নেতাকে দন্ড দান করা হবে? তার অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী কি তাকে দন্ডদান করা যাবে? খুব বেশী হলে তাকে মৃতুদন্ড দিয়ে তা কার্যকর করা যেতে পারে।
আবার প্রশ্ন ওঠে, যে ব্যক্তি জাতীয় নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়ে গোটা জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ধ্বংস করলো, জাতিকে ভিন্ন জাতির গোলামে পরিণত করলো, অবাধে নিজে সন্তান-সন্ততি সাথে করে জাতীয় অর্থ-সম্পদ লুট করলো, দলের লোকদের দিয়ে লুট করালো, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানী ঘটালো। তার কারণে অসংখ্য নারী সতীত্ব হারালো- অর্থাৎ বিশাল পর্বত সমান অপরাধের পরিবর্তে লাভ করলো শুধু মৃত্যুদন্ড। অগণিত মানুষ নিহত হলো যার কারণে, আর সে একবার মাত্র নিহত হলো- এটা কি ইনসাফ হলো ? আসলে মানুষ ইনসাফ করবে কিভাবে? মানুষের পক্ষে তো সম্ভব নয়, লক্ষ লক্ষ নরহত্যার অপরাধে দন্ডিত ব্যক্তিকে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বার হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণ করা। মানুষের পক্ষে কাউকে একবারই হত্যা করা বা মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা সম্ভব- বার বার নয়। এখানেও ইনসাফের দাবি হলো, মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন থাকা উচিত। যেখানে লক্ষ নরহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত অপরাধীকে লক্ষ বার শস্তি দেয়া যেতে পারে।
পৃথিবীর কারাগারগুলোয় যেসব বন্দী রয়েছে, এসব বন্দীদের মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তিই কি প্রকৃত অপরাধী? কোন একটি দেশের সরকারও এ কথা হলফ করে বলতে পারবে না যে, তার দেশের কারাগারের সকল বন্দী প্রকৃত অপরাধী। এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা প্রতিহিংসা, ষড়যন্ত্র, প্রতিশোধ, আক্রোশ ইত্যাদির শিকার হয়ে বছরের পর বছর ধরে অন্যায়ভাবে কারাগারে অমানবিক নির্যাতন ভোগ করছে। আল্লাহর দেয়া পৃথিবীর মুক্ত আলো-বাতাস থেকে নির্দোষ লোকগুলোকে বঞ্চিত করা হয়েছে। স্বামী সঙ্গ থেকে স্ত্রীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সন্তান-সন্ততিকে পিতার স্নেহ থেকে মাহ্‌রুম করা হয়েছে।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিকে কারাবন্দী করার কারণে তার সংসার তছ্‌নছ্‌ হয়ে পড়েছে। স্ত্রীকে অপরের বাড়িতে কঠোর শ্রমের বিনিময়ে ক্ষুন্নি বৃত্তি নিবৃত্ত করতে হচ্ছে। নাবালেগ সন্তানগণ শিক্ষা জীবন থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এক মুঠো অন্নের জন্য শ্রম বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে অবিচার মানব সভ্যতার মেকি মানবাধিকারের গালে বার বার চপেটাঘাত করছে। নেই- কোথাও এদের সুবিচার লাভের এতটুকু আশা নেই। সমাজের প্রভাব প্রতিপত্তিশালী কামনা তাড়িত ব্যক্তির দৃষ্টি পড়লো গরীব-দিন মজুর এক ব্যক্তির সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি। তার যৌবনকে লেহন করার যাবতীয় প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো, তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সাথে ষড়যন্ত্র করে সেই দিন-মজুরকে চোর বা ডাকাত সাজিয়ে কারাগারে ঢুকিয়ে দিয়ে কয়েক বছর জেল দেয়া হলো। এরপর দিন-মজুরের অসহায় সুন্দরী স্ত্রীকে ভোগ করার অবাধ পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো।
এই অবিচারের কোন প্রতিকার করার মতো শক্তি সামর্থ গরীব-দিন মজুরের নেই। তার অর্থ নেই, প্রভাব নেই, প্রতিপত্তি নেই। আইন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সে জামিন নেবে, সে অর্থও তার নেই। কারণ পৃথিবীতে প্রচলিত মানুষের তৈরী করা আইনের অবস্থা হলো মাকড়শার জালের মতোই। মাকড়শার জালে যেমন কোন শক্তিশালী মাছি আট্‌কা পড়লে তা ছিন্ন করে বের হয়ে যায় এবং দুর্বল কোন প্রাণী ধরা পড়লে সেই জাল ছিন্ন করতে পারে না। মাকড়শা তাকে কুরে কুরে খায়। পৃথিবীতে আইন প্রভাব-প্রতিপত্তি ও অর্থের কাছে বিক্রি হয়। এখানে অসহায় দুর্বল মানুষগুলোর সুবিচার লাভের কোন আশা করা যেতে পারে না। কিন্তু মানুষ হিসাবে, মানবাধিকারের দৃষ্টিতে তারও তো সুবিচার পাবার অধিকার ছিল। তাহলে অসহায় আর দুর্বলরা কি কোনদিন সুবিচার লাভ করবে না?
বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, আলজিরিয়া, ম্যাসেডোনিয়া, ফিলিস্তীন, কাশ্মির, সোমালিয়া, ফিলিপাইন, সুদান, আফগানিস্থান ও ইরাকসহ অনেক দেশেই মুসলিম বিদ্বেষী পৃথিবীর সুপার পাওয়ার মোড়ল রাষ্ট্রটির প্রত্যক্ষ মদদে অগণিত মুসলিম নারী-পুরুষ আবাল বৃদ্ধ-বণিতা লোমহর্ষক হত্যা কান্ডের শিকারে পরিণত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। পৃথিবীতে এদের জন্মই যেন হয়েছে নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে জীবনকে বলী দেয়া। পৃথিবীবাসীর চোখে ধূলো দেয়ার জন্য তথাকথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ বৈঠকের নামে ভোজ সভার আয়োজন করছে। প্রকৃতপক্ষে হত্যাযজ্ঞকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যেই বৈঠকের নামে কলক্ষেপণ করা হচ্ছে। একদিকে হত্যাযজ্ঞ বন্দ করার নামে যে মুহূর্তে বৈঠক চলছে, অপরদিকে সেই মুহূর্তেই অগণিত আদম সন্তান মারণাস্ত্রের নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হচ্ছে। এভাবে সর্বত্র চলছে অন্যায় আর অবিচার। কিন্তু কোন প্রতিকারের ব্যবস্থা আজ পর্যন্তও করা হয়নি। বিচারের আশায় অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদ অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠের কঠিন দেয়ালে মাথা কুটে ফিরছে। নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর মর্ম যন্ত্রণার করুণ হাহাকার পৃথিবী জুড়ে বেদনা বিধুর পরিবেশ সৃষ্টি করছে। প্রতিকার আর সুবিচার লাভের সামান্য আশার আলোও কোথাও চোখে পড়ছে না।
পৃথিবীর এই বাস্তব অবস্থাই মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বিচার দিবসের প্রয়োজনীয়তা আর মৃত্যুর পরের জীবনের আবশ্যকতা। পৃথিবীতে যদি যাবতীয় কাজের যথার্থ প্রতিফল লাভের বাস্তব অবস্থা বিরাজ করতো, তাহলে পরকালের জীবন সংশয়পূর্ণ হতো। পৃথিবীতে কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন ও প্রতিফল দানের ক্ষমতা মানুষের নেই। এই ব্যবস্থা মানুষ কোনদিনই যথার্থভাবে করতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তি এটাই দাবি করে যে, এমন একটি জীবন অবশ্যই থাকা উচিত, যে জীবনে মানুষ তার প্রতিটি কর্মের যথোপযুক্ত প্রতিফল লাভ করবে। আর কর্ম সম্পাদনের পূর্বে যেমন ফল আশা করা যায় না, তেমনি মৃত্যুর পূর্বে মানুষও তার কর্মফল আশা করতে পারে না। কারণ মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার কর্মের অবসান ঘটে। এ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিচার দিবস নির্ধারণ করেছেন। সেদিন তিনি প্রতিটি মানুষের কর্মলিপি অনুসারে বিচার কার্য অনুষ্ঠিত করবেন।

সমস্ত কিছুই সৃষ্টি হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য

সৃষ্টি সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রথম বিষয় বলা হলো, কোন কিছুই বৃথা সৃষ্টি হয়নি- সমস্ত কিছুই একটি নির্দিষ্ট ছক অনুসারে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রতিটি সৃষ্টির পেছনেই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রয়েছে। এরপর মানব জাতির সামনে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসেছে, এসব সৃষ্টি নশ্বর না অবিনশ্বর? এ প্রশ্নের জবাব লাভের জন্য চিন্তাবিদ ও গবষেকগণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন সৃষ্টিসমূহের প্রতি। তারা নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এখানে কোন জিনিসই অবিনশ্বর বা চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি জিনিসেরই একটি নির্ধারিত জীবনকাল নির্দিষ্ট রয়েছে। নির্দিষ্ট সেই প্রান্ত সীমায় পৌঁছানোর পরে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। সামগ্রিকভাবে গোটা সৃষ্টি জগতসমূহও একটি নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে, এ কথা আজ বিজ্ঞানীগণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তারা বলছেন, এখানে দৃশ্যমান- অদৃশ্যমান যতগুলো শক্তি সক্রিয় রয়েছে তারা সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ পরিসরে তারা কাজ করে যাচ্ছে। সমস্ত শক্তি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ করবে। তারপর কোন এক সময় তারা অবশ্যই নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং এ ব্যবস্থাটির পরিসমাপ্তি ঘটবে।
সুদূর অতীতকালে যেসব চিন্তাবিদগণ পৃথিবীকে আদি ও চিরন্তন বলে ধারণা পেশ করেছিলেন, তাদরে বক্তব্য তবুও সর্বব্যাপী অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে কিছুটা হলেও স্বীকৃতি লাভ করতো। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে নাস্তিক্যবাদী ও আল্লাহ বিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্ব-জগতের নশ্বরতা ও অবিনশ্বরতা নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, আধুনিক বিজ্ঞান প্রায় চূড়ান্তভাবেই সে ক্ষেত্রে আল্লাহ বিশ্বাসীদের পক্ষে রায় দিয়েছে। সুতরাং বর্তমানে নাস্তিক্যবাদীদের পক্ষে বুদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের  নামাবলী গায়ে দিয়ে এ কথা বলার আর কোন অবকাশ নেই যে, এই পৃথিবী আদি ও অবিনশ্বর। কোনদিন এই জগৎ ধ্বংস হবে না, নাস্তিক্যবাদীদের জন্য এ কথা বলার মতো কোন সুযোগ বিজ্ঞানীগণ আর রাখেননি। তারা কোরআনের অনুসরণে স্পষ্টভাবে মত ব্যক্ত করেছেন যে, এই পৃথিবী ও সৃষ্টিজগতের সমস্ত কিছুই একটি নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে। অতীতে বস্তুবাদিরা এ ধারণা প্রচলন করেছিল যে, বস্তুর কোন ক্ষয় নেই- বস্তু কোনদিন ধ্বংস হয় না, শুধু রূপান্তর ঘটে মাত্র। তাদের ধারণা ছিল, প্রতিটি বস্তু পরিবর্তনের পর বস্তু- বস্তুই থেকে থেকে যায় এবং তার পরিমাণে কোন হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। এই চিন্তা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে বস্তুবাদীরা প্রচার করতো যে, এই বস্তু জগতের কোন আদি-অন্ত নেই। সমস্ত কিছুই অবিনশ্বর। কোন কিছুই চিরতরে লয় প্রাপ্ত হবে না।
পক্ষান্তরে বর্তমানে আনবিক শক্তি আবিষ্কৃত হবার পরে বস্তুবাদীদের ধ্যান-ধারণার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আধুনিক বিজ্ঞানীগণ বলছেন, শক্তি বস্তুতে রূপান্তরিত হয় এবং বস্তু আবার শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই বস্তুর শেষ স্তরে এর কোন আকৃতিও থাকে না এবং এর কোন ভৌতিক অবস্থানও বজায় থাকে না। তারপর ওণডমভঢ ফটষ মতর্ দণরবম-ঊহভটবধড্র এ কথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এই বস্তুজগৎ অবিনশ্বর নয়, এটা অনন্ত নয় এবং তা হতে পারে না। এই বস্তুজগৎ যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি এটি একদিন শেষ হয়ে যাবে। কোরআন সপ্তম শতাব্দীতে যে ধারণা মানব জাতির সামনে পেশ করেছিল, বর্তমানের বিজ্ঞানীগণ তা নতুন মোড়কে মানব জাতির সামনে উত্থাপন করছে।
কোরআন বলেছে, এই জগতের একদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে- বিজ্ঞান এ কথার স্বীকৃতি দানে বাধ্য হয়েছে। কোরআন বলেছে, এই সৃষ্টিজগৎ ক্রমশঃ সম্প্রসারিত হচ্ছে- বিজ্ঞান অনেক জল ঘোলা করে তারপর এ কথার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে যে, সত্যই- মহাশূন্যে সমস্ত কিছু সম্প্রসারিত হচ্ছে। একটি গ্যালাি আরেকটি গ্যালাঙ্রি কাছ থেকে প্রতি সেকেন্ডে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার বেগে অজানার পথে সৃষ্টির সেই শুরু থেকেই ছুটে চলেছে। কোথায় যে এর পরিসমাপ্তি- তা বিজ্ঞান অনুমান করতে যেমন পারছে না, তেমনি অনুমান করতে পারছে না, মহাশূন্য কতটা বিশাল। এই সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার একদিন সমাপ্তি ঘটবে, তখন শুরু হবে আবার সংকোচন প্রক্রিয়া। মহাশূন্যে সমস্ত কিছুই যে ক্রমশঃ সম্প্রসারিত হচ্ছে, এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আমি আকাশ মন্ডলীকে নিজস্ব শক্তিবলে সৃষ্টি করেছি আর একে আমি সম্প্রসারিত করছি। (সূরা যারিয়াত-৪৭)
সম্প্রসারণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীগণ একসাথে অনেকগুলো গ্যালাঙ্রি ওপরে গবেষণা করে দেখেছেন যে, সম্প্রসারণের ধরণটা কেমন। তারা দেখতে পেয়েছেন যে, সম্প্রসারণের ধরণটি একটি অন্যটির সমান্তরাল নয়। তারা ধারণা করেন, একটি গ্যালাি অন্য আরেকটি গ্যালাি অথবা একাধিক গ্যালাি ক্রমশঃ দূরত্ব সৃষ্টি করে চলেছে। বিষয়টিকে তারা সহজবোধ্য করার জন্য বেলুনের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। একটি বেলুনে বাতাস দিতে থাকলে তা যেমন ক্রমশঃ ফুলতেই থাকে, তারপর তা এক সময় ফেটে যায় এবং রাবারের টুকরোগুলো চারদিকে ছিটকে পড়ে। বেলুন ফুলতে থাকাবস্থায় তার ভেতরের স্থান যেমন সম্প্রসারিত হতে থাকে, তেমনি এই মহাশূন্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। নক্ষত্রসমূহ কোন গ্যালাি ব্যবস্থার পরিমন্ডলে যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি এই মহাবিশ্ব প্রতি মুহূর্তে প্রবল গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
পৃথিবী এবং গ্যালাী কেন্দ্রের মাঝে অবস্থিত বাহুটি প্রতি সেকেন্ডে তিপ্পান্ন কিলোমিটার বেগে এবং তার বিপরীত বাহুটি প্রতি সেকেন্ডে একশত পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার বেগে সম্প্রসারিত হচ্ছে। কোন গ্যালাস্কি সেকেন্ডে পঁয়তাল্লিশ হাজার মাইল বেগে, কোনটি সেকেন্ডে নব্বই হাজার মাইল বেগে আবার কোনটি সেকেন্ডে আলোর গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
সৃষ্টির আদি থেকেই এই সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া চলছে। কোথায় যে এরা ছুটে যাচ্ছে, তা বিজ্ঞানীগণ আবিষ্কার করতে সমর্থ হননি। এই গ্যালাঙ্গুিলো একটি আরেকটিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না। তারা একেবারে সোজা পিছে সরে যাচ্ছে। মহাকর্ষ বলের কারণে প্রতিটি গ্যালাি একে অপরকে আকর্ষণ করে। এরপরও তারা পরস্পরের কাছে ছুটে আসতে পারে না। কারণ গোটা মহাবিশ্ব ব্যাপী একটি সম্প্রসারণ বল সক্রিয় রয়েছে। এই বল এখনো মহাকর্ষ বলের থেকে অনেক বেশী এবং এ কারণেই মহাবিশ্ব সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু মহাকর্ষ বল প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করছে গ্যালাঙ্গুিলোকে পরস্পরের দিকে টেনে নিয়ে আসার জন্য। এই মহাকর্ষ বলের কারণেই ক্রমশঃ একদিন গ্যালাঙ্গুিলোর পশ্চাদপসরণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এক কথায় মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ গতি হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীগণ মতামত দিচ্ছেন।
তারপর মহার্কষ বলের কারণেই গ্যালাঙ্গুিলো পরস্পরের দিকে ছুটে আসতে শুরু করবে আর এভাবেই শুরু হবে মহাবিশ্বের সংকোচন প্রক্রিয়া। ক্রমান্বয়ে মহাবিশ্ব কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত হতে থাকবে, সময় যতই অতিবাহিত হবে, গ্যালাঙ্গুিলোর পরস্পরের প্রতি ছুটে আসার গতি ততই বৃদ্ধি লাভ করবে। এভাবে এক সময় সমস্ত গ্যালাক্সি তাদের যাবতীয় পদার্থ তথা নক্ষত্র, উন্মুক্ত গ্যাস, ধূলিকণা ইত্যাদিসহ মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পরস্পরের ওপরে পতিত হবে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, সংকোচনের শেষ পর্যায়ে মহাবিশ্বের সমস্ত গ্রহ, নক্ষত্র তথা সৃষ্টি জগতের যাবতীয় পদার্থ, মহাবিশ্বের কেন্দ্রে একত্রিত হয়ে একটি ক্ষুদ্র পিন্ডে পরিণত হবে। সমাপ্তিতে সৃষ্টি জগতের এই একত্রিত অবস্থাকে বিজ্ঞানীগণ বিগ্‌ ক্রাঞ্চ (ইরম ঈৎঁহপয) নামে আখ্যায়িত করেছেন।
পৃথিবীর ও মহাবিশ্বের ভবিষ্যত তথা পরিণতি সম্পর্কে উল্লেখিত ধারণা পোষণ করছে বর্তমানের বিজ্ঞানীগণ। তারা বলছেন, তাপের উৎস হলো সূর্য। আর এই তাপের কারণেই গোটা সৃষ্টিজগৎ সচল রয়েছে। অথচ এই সূর্য ক্রমশঃ তার জ্বালানি শক্তি নিঃশেষ করে ফেলছে। অর্থাৎ সূর্য একটি পরিণতির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। মহান আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টির জন্যই একটি নির্দিষ্ট সীমা রেখা অঙ্কন করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
তারা কি কখনো নিজেদের মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করেনি? আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশ মন্ডলী এবং তাদের মাঝখানে যা কিছু আছে সবকিছু সঠিক ও উদ্দেশ্যে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আর রূম-৮)
এই পৃথিবীতে যা কিছুই সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অনাদি ও অনন্ত নয়, এ কথা বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। দৃষ্টির সামনেই মানুষ প্রতিনিয়ত দেখছে, পুরাতনের স্থানে নতুনের আগমন ঘটছে। কিন্তু এর একদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিভাবে- কি করে ঘটবে তা গবেষকদের কাছে আর অনাবৃত নেই।

পরকালীন জীবন প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিবেক ও ইনসাফের দাবী

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসীম দয়ালু- কথাটি অনুধাবন করার জন্য কোন গবেষণার প্রয়োজন নেই। মাত্র একটি বারের জন্য গোটা সৃষ্টির প্রতি এবং নিজের দেহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই বিষয়টি দিবালোকের মতই স্পষ্ট হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরা- সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতেই আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর অসীম দয়া ও অনুগ্রহের কথা মানব জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন। এরপর তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ কিভাবে কোথায় কার্যকর করেছেন, তা কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আলোচনা করে মানব জাতির দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে দয়া ও অনুগ্রহের কথা জানিয়েই তিনি ঘোষণা করেছেন- তিনিই বিচার দিবসের মালিক।
দয়া অনুগ্রহ ও বিচার দিবসের মালিক- দুটো বিষয়ের পাশাপাশি উল্লেখ করার কারণ হলো, পৃথিবীর মানব-মন্ডলীর কাছে তিনি এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন- তিনি শুধু অসীম দয়ালুই নন, তিনি ন্যায় বিচারক, ইনসাফকারী, তিনি অধিকার প্রদানকারী। পৃথিবীতে আল্লাহর উন্মুক্ত ও অবারিত দয়া পরিবেষ্টিত থেকে শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে যারা ন্যায় বিচারকে ভূলুন্ঠিত করছে, অপরের অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, দুর্বলকে ইনসাফ থেকে বঞ্চিত করছে, তিনিই আল্লাহ- যিনি বিচার দিবসে বিচারকের আসনে আসীন হয়ে ন্যায় বিচার করবেন। পৃথিবীতে যারা অধিকার বঞ্চিত ছিল, তাদেরকে তিনি প্রাপ্য অধিকার প্রদান করবেন- ইনসাফ করবেন।
একজন ব্যক্তি দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে মহান আল্লাহর দেয়া জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করলো এবং সে নিয়ম-পদ্ধতি দেশের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালো। প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে সে কারাগারে যেতে বাধ্য হলো, নির্যাতিত হলো, সহায়-সম্পদ থেকে বঞ্চিত হলো। দেশের জনগণ এবং জাতির কর্ণধারগণ লোকটির আবিষ্কৃত কল্যাণকর নিয়ম-পদ্ধতির কল্যাণকারিতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে অথবা অবহেলা করে তার নিয়ম-পদ্ধতি গ্রহণ করলো না বরং তার প্রতি নানা ধরনের নির্যাতন অনুষ্ঠিত করলো। এরপর নিয়ম মাফিক লোকটি একদিন এ পৃথিবী থেকে একবুক হাহাকার নিয়ে চিরবিদায় গ্রহণ করলো। তার ইন্তেকালের অনেক বছর পরে নতুনভাবে যারা দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো, তারা এসে দেখলো, ঐ লোকটি কর্তৃক আবিষ্কৃত নিয়ম-পদ্ধতি দেশের বুকে প্রতিষ্ঠিত করলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে এবং তারা বাস্তবে তাই করলো। দেশ ও জাতি লোকটির প্রবর্তিত নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে সমৃদ্ধশালী জাতিতে পরিণত হলো।
জাতি যখন লোকটির প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করতে সক্ষম হলো, তখন তার প্রতি শ্রদ্ধায় গোটা জাতি বিগলিত হলো। লোকটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরণ তার নামে করা হলো। প্রতি বছরে তার জন্ম-মৃত্যু দিবসে সংবাদ পত্রসমূহ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলো। তাকে মূল্যায়ন করে নানা ধরনের বই-পুস্তক প্রকাশ হলো। কেউ কেউ তার আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করা শুরু করলো। তার নামে বিভিন্ন ধরনের পদক প্রবর্তন করা হলো।
এসব করা হলো ঐ ব্যক্তির জন্য, যাকে একদিন গোটা জাতি লাঞ্ছিত করেছিল, নির্মম অত্যাচারে জর্জরিত করেছিল, কারারুদ্ধ করেছিল, তার সহায়-সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে তাকে দেশান্তরী করেছিল। তারপর লোকটির ইন্তেকালের বহু বছর অতিক্রান্ত হবার পর উপলব্ধিবোধ ফিরে আসার পরে জাতি তাকে পুরস্কৃত করার জন্য উল্লেখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলো। অর্থাৎ মানুষের পক্ষে বিনিময় দেয়ার যতগুলো পন্থা রয়েছে, তার সবগুলোই অবলম্বন করা হলো।
এখন প্রশ্ন হলো, পরবর্তীতে মৃত সেই লোকটির জন্য যা করা হলো, এসবই কি লোকটির যথার্থ প্রাপ্য ছিল, না এরচেয়ে আরো বেশী কিছু প্রাপ্য ছিল? আর প্রাপ্য থাকলেও মানুষের পক্ষে লোকটির জন্য আরো বেশী কিছু করা কি সম্ভব? মাত্র একটি লোকের প্রচেষ্টায় অসংখ্য অগণিত লোক উপকৃত হলো, একটি দেশ ও জাতি বিশ্বের দরবারে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হলো, তার কারণে জাতি অনিয়ম, দুর্নীতি, অরাজকতা, বিশৃংখলতা, দারিদ্র থেকে মুক্তি লাভ করে শান্তি ও স্বস্তির জীবন লাভ করলো, তাকে কি কোনভাবেই মানুষের পক্ষ থেকে তার কর্মের বিনিময় স্বরূপ যথার্থ পুরস্কার প্রদান করা সম্ভব?
অনুরূপভাবে আরেকজন লোক এমন এক মতবাদ আবিষ্কার করলো, রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করে এমন নিময়-পদ্ধতির প্রবর্তন করলো এবং একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করলো। তার সেই ঘৃণ্য মতবাদের কারণে যুগের পর যুগ ধরে অগণিত মানুষ চরম দুরাবস্থার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হলো। এখন সেই মতবাদের আবিষ্কারককে কি কোনভাবেই দন্ড প্রদান করা সম্ভব? আর মানুষের নিয়ন্ত্রণে যত ধরনের দন্ড রয়েছে, তার সবগুলোই প্রয়োগ করলে কি লোকটিকে যথার্থ দন্ড দেয়া হবে? সুতরাং, মানুষের পক্ষে আরেক জন মানুষের কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ মানুষের শক্তি ও সামর্থ সীমিত। এ জন্য মানুষের পক্ষে যথার্থ পুরস্কার ও দন্ড দেয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাহলে কি মানুষ প্রকৃত পুরস্কার ও দন্ড লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে? প্রকৃত পুরস্কার ও দন্ডের ব্যবস্থা মানুষের আয়ত্বে নেই, এ কারণে মানুষের ভেতরে যে হতাশা, এই হাতাশা বোধেই কি মানবাত্মা অনন্তকাল ধরে আর্তনাদ করতে থাকবে ? এই হতাশা দূর করার জন্যই আল্লাহ রাহ্‌মান ও রাহীম। তিনি অসীম অনুগ্রহ ও করুণার অধিকারী। পৃথিবীতে যেমন তিনি মানুষের ওপরে অসীম করুণা করেছেন, তেমনি তিনি করুণা করবেন বিচার দিবসে। যেদিন তিনি করুণা করে যথার্থ পুরস্কার ও দন্ডের ব্যবস্থা করবেন এবং ন্যায় বিচার পরিপূর্ণ করার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবেন। এ কারণেই তিনি সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে দয়া ও অনুগ্রহের বিষয়টি উল্লেখ করার পরপরই তৃতীয় আয়াতে বিচার দিবসের বিষয়টি নিশ্চিত করে মানব জাতিকে হতাশা মুক্ত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
যে সৎ কাজ করবে সে নিজের জন্যই কল্যাণ করবে। আর যে দুষ্কর্ম করবে তার মন্দ পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে। তোমার রব্ব বান্দাদের জন্য জালিম নন। (সূরা হামীম সিজ্‌দা)
যার যা প্রাপ্য তাকে না দেয়াই হলো তার ওপরে জুলুম অনুষ্ঠিত করা এবং পৃথিবীতে এই জুলুম প্রতি মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জ্ঞান বিবেক বুদ্ধি এই জুলুমের অবসান কল্পে আর্তচিৎকার করছে। আল্লাহ তা’য়ালা বিচার দিবসে এই জুলুমের অবসান ঘটাবেন। মানুষের জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি এটাই দাবি করছে যে, যথার্থভাবে মানুষের কর্মের মূল্যায়ন ও তদানুযায়ী পুরস্কার এবং দন্ডের আয়োজন করা হোক। আর যেহেতু জীবিত থাকাবস্থায় মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়।
এজন্য মৃত্যুর পরে আরেকটি বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে সেখানে এসবের ব্যবস্থা করা উচিত। জীবিত কালে মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করা এ কারণে সম্ভব নয় যে, মানুষ এমন একটি কর্ম সম্পাদন করলো, যার ফলে গোটা জাতির কাছে সে প্রশংসিত হলো। আবার সেই একই ব্যক্তির দ্বারা এমন এক জঘন্য কর্ম অনুষ্ঠিত হলো, গোটা জাতির কাছে সে নিন্দিত হলো। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ ধরনের নিন্দিত ও প্রশংসিত নেতার অভাব নেই। সারা জীবন ধরে এক ব্যক্তি প্রশংসামূলক কর্ম সম্পাদন করলো, মৃত্যু শয্যায় শায়িত থেকে সেই একই ব্যক্তি, এমন এক নিন্দিত কাজের অনুমোদন দিয়ে গেল যে, গোটা জাতি তার মৃত্যুর পরে শোকাহত হবার পরিবর্তে তার প্রতি ধিক্কারই জানালো। এ জন্য জীবিত থাকাবস্থায় কোন মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। মানুষের প্রতিটি খুটিনাটি কাজের মূল্যায়ন পূর্বক পুরস্কার ও দন্ডদানের ব্যবস্থার জন্যই নির্দিষ্ট করা হয়েছে বিচার-দিবস। এটা মহান আল্লাহর উন্মুক্ত ও অবারিত দয়া-অনুগ্রহের অসীম প্রকাশ।
পৃথিবীর বিচারালয় সম্পর্কে মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো, বিচারক স্বয়ং নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে বিচার কার্য অনুষ্ঠিত করে থাকেন। যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিচারক বিচার করেন, সে বিষয়টি যেখানে সংঘটিত হয়, সেখানে বিচারক স্বশরীরে উপস্থিত থেকে ঘটনার প্রতিটি দিক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার কোন উপায় তার থাকে না। বিচার কার্য পরিচালনার সাথে যারা জড়িত, তাদের কাছ থেকে ঘটনাবলী শুনে বিচারক বিচার করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও পূর্ণ ঘটনা তার গোচরে আসার সম্ভাবনা নেই। উভয় পক্ষের উকিল এবং সাক্ষীগণ নিজের স্বার্থে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করে থাকে। এক কথায় পৃথিবীতে বিচার কার্য পরিচালনা করার সময় মানুষ বিচারককে যতগুলো দুর্বলতা পরিবেষ্টন করে রাখে, এর সবগুলো থেকে মহান আল্লাহ পাক ও পবিত্র। ঘটনা যেখানে সংঘটিত হয়, তা মহান আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে থাকে না। কেন ঘটনা সংঘটিত হলো, সেটাও তিনি অবগত থাকেন এবং যেখানে যার দ্বারাই সৎকাজ ও অসৎকাজ সংঘটিত হচ্ছে, সমস্ত কিছুই তিনি অবগত থাকেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আল্লাহর তাস্‌বীহ করছে এমন প্রতিটি জিনিস যা আকাশ জগতে রয়েছে এবং এমন প্রতিটি জিনিস যা পৃথিবীর বুকে রয়েছে। তিনিই সার্বভৌমত্বের একমাত্র অধিকারী এবং প্রশংসাও তাঁরই জন্য। আর তিনি প্রতিটি জিনিসের ওপর কতৃêত্বের অধিকারী। তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ মুমিন আর কেউ কাফির। আর আল্লাহ সেসব কিছুই দেখেন যা তোমরা করে থাকো। (সূরা আত তাগাবুন-১-২)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিচার দিবসের মালিক, সৃষ্টিজগতে যা কিছুই রয়েছে সমস্ত কিছুই তাঁর প্রশংসা করছে। সমস্ত সৃষ্টির ওপরে একমাত্র তাঁর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সৃষ্টির ওপরে কারো কতৃêত্ব চলে না, কতৃêত্ব একমাত্র তাঁর। পৃথিবীতে মানুষকে প্রেরণ করে তিনি তাদেরকে সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য দেখিয়ে দিয়ে স্বাধীন ক্ষমতা দান করেছেন, মানুষ আল্লাহ প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করে মুমিনও হতে পারে আবার শয়তানের পথ অনুসরণ করে কাফিরও হতে পারে। মানুষ কোথাও কোন অবস্থায় অন্ধকারে চার দেয়ালের মধ্যে লোক চক্ষুর অন্তারালে কি করছে সেটাও তিনি দেখছেন। সুতরাং একমাত্র তাঁর পক্ষেই যাবতীয় ঘটনার ন্যায় বিচার করা সম্ভব। বিচারক যদি ন্যায় বিচার করে, তাহলে সেটা তার সততা, দয়া ও অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। আর বিচারক যদি ন্যায় বিচার না করে নির্দোষকে আসামী করে শাস্তি প্রদান করেন আর দোষীকে ক্ষমা করে দিয়ে কোন দন্ডদান না করেন, এটা বিচারকের হীন ও কলুষিত মানসিকতার স্বাক্ষর বহন করে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনুগ্রহ করে বিচার দিবসকে নির্দিষ্ট করেছেন এবং সেদিন তিনি ন্যায় বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে দন্ডদান করবেন এবং পুরস্কার লাভের অধিকারীদের পুরস্কার প্রদান করবেন। সৎকর্মের পুরস্কার হিসাবে যারা জান্নাতে গমন করবেন, তারাও যেমন আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে ধন্য তেমনি যারা অসৎ কাজের বিনিময় হিসাবে জাহান্নামে গমন করবে, তারাও আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও ইনাসাফ লাভ করেই যথাস্থানে গমন করবে। একদল মানুষ শাস্তি লাভের জন্য জাহান্নামে গমন করছে, এটা আল্লাহর ক্রোধের প্রকাশ নয়। এটাও তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের প্রকাশ। কারণ তিনি দয়া করে ন্যায় বিচার করবেন এবং যেখানে যার স্থান তাকে সে স্থানেই প্রেরণ করার ব্যবস্থা করবেন। মানুষের যাবতীয় কার্যাবলী তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তার হৃদয় কি কল্পনা করে, তাও তিনি জানেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
পৃথিবী ও আকাশমন্ডলের প্রতিটি বিষয় তিনি জানেন। তোমরা যা কিছু গোপন করো আর যা কিছু প্রকাশ করো, তা সবই তিনি জানেন। তিনি মানুষের হৃদয়সমূহের অবস্থাও জানেন।
একদিকে আল্লাহ স্বয়ং প্রত্যক্ষভাবে মানুষের গতিবিধি, যাবতীয় কার্যকলাপ ও তার চিন্তা-কল্পনা, কামনা-বাসনা সমস্ত কিছুই জানেন। অপরদিকে প্রতিটি মানুষের সাথে দু’জন করে ফেরেশ্‌তা নিযুক্ত করেছেন। তারা মানুষের সাথে সম্পর্কশীল প্রতিটি কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করে রাখছে। মানুষের কোন কথা বা কাজ রেকর্ডের বাইরে অলিখিত থাকে না। বিচার দিবসে আল্লাহর আদালতে যখনই মানুষকে উপস্থিত করা হবে, তখন পৃথিবীর জীবনে কে কি করেছে, তখন তাদের সামনে তা প্রদর্শন করা হবে।
শুধু তাই নয়, দু’জন ফেরেশ্‌তাও সাক্ষী হিসাবে দন্ডায়মান থাকবেন। তারা মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপের লিখিত ও ধারণকৃত ছবি প্রমাণ হিসাবে পেশ করবেন। বিচার দিবসে আল্লাহর আদালতে মানুষ পৃথিবীতে যত কথা বলেছিল, সে কথাগুলো নিজের কানে নিজের কন্ঠেই শুনতে পাবে। শুধু তাই নয়, নিজের চোখ দিয়ে তার যাবতীয় কর্মকান্ডের চলমান ছবি এমনভাবে দেখতে পাবে যে, ঘটনার যথার্থতা ও নির্ভুলতাকে অস্বীকার করা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
মানুষকে সৃষ্টি করেছি আমি এবং তার মনে প্রতি মুহূর্তে কখন কি কল্পনা-কামনা-বাসনার উদয় তাও আমি জানি। আমি তার কন্ঠের শিরার থেকে অত্যন্ত কাছে অবস্থান করছি। দু’জন লেখক তার ডান ও বাম দিকে অবস্থান করে প্রতিটি বিষয় লিপিবদ্ধ করে রাখছে। মানুষ এমন কোন শব্দই উচ্চারণ করে না যা সংরক্ষণের জন্য একজন চির-উপস্থিত পর্যবেক্ষক মওজুদ থাকে না। (সূরা ক্বাফ)
মানুষ সৃষ্টিগতভাবে ন্যায় ও ইনসাফের মুখাপেক্ষী। যার দ্বারায় অন্যায় সংঘটিত হয়, সে ব্যক্তিও তা ন্যায় মনে করে সংঘটিত করে না। তার বিবেকই তাকে কর্মটি সম্পর্কে জানিয়ে দেয় যে- এটা অন্যায় কর্ম। সুতরাং মানুষের দ্বারা সংঘটিত যাবতীয় কর্মই দাবি করে যে, এসব কর্মের চুলচেরা বিচার হওয়া উচিত এবং উপযুক্ত কর্মফল লাভ করা উচিত। আল্লাহ রাহ্‌মান ও রাহীম, এটা তাঁর অসীম অনুগ্রহ যে, তিনি মানুষের যাবতীয় কর্মফল যথাযথভাবে দান করার জন্যই ইনসাফের দাবি অনুসারে বিচার দিবস নির্দিষ্ট করেছেন।

আখিরাত অস্বীকারকারীদের যুক্তি

মানব-মন্ডলীকে সঠিক পথপ্রদর্শনের লক্ষ্যে এই পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসূল আগমন করেছেন এবং তাঁরা সকলেই মানুষকে বিচার দিবস সম্পর্কে অবহিত করেছেন। তাঁরা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিচার দিবস নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। পৃথিবীতে মানুষ যা কিছু বলছে এবং করছে, বিচার দিবসে এসব কিছুর চুলচেরা বিচার করা হবে ও কর্মলিপি অনুসারে মানুষ পুরস্কৃত হবে এবং দন্ডলাভ করবে। অর্থাৎ মৃত্যুর পরবর্তী জীবনই হলো মানুষের আসল জীবন- সেই জীবনে যে ব্যক্তি সফলতা অর্জন করতে পারবে, সেটাই প্রকৃত সফলতা। আর সেই সফলতা অর্জন করতে হলে পৃথিবীতে মানুষকে অবশ্যই মহান আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান অনুসরণ করতে হবে। নবী-রাসূলগণ যখনই বিচার দিবসের কথা বলেছেন, তখনই এক শ্রেণীর মানুষ মৃত্যুর পরের জীবনের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে নানা ধরনের যুক্তি প্রদর্শন করেছে এবং এ ব্যাপারে বিদ্রোহীর ভূমিকা অবলম্বন করেছে। এ ধরনের বিদ্রোহী ভূমিকা শুধু সেই যুগের মানুষই অবলম্বন করেনি, প্রতিটি যুগেই এটা করা হয়েছে। পরকালে অবিশ্বাসী মানুষগুলো প্রতিটি যুগেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে বিরোধিতা করেছে, এখনও করছে এবং পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত করতে থাকবে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, বিচার দিবসের কথা শোনার সাথে সাথে একশ্রেণীর মানুষ কেন প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে উঠেছে এবং প্রবল বিরোধিতার ঝান্ডা উড্ডিন করেছে? কেন তারা নানা ধরনের যুক্তির অবতারণা করে বিচার দিবসকে অস্বীকার করেছে? কেন তারা ঐ লোকগুলোর ওপরে নির্যাতন শুরু করেছে, যারা বিচার দিবস সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেই শুরু থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাহলো, যুগে যুগে যারা পরকাল অস্বীকার করেছে, বিচার দিবস সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করেছে, ঐ দিনটি সম্পর্কে বিতর্ক করেছে, এই বিতর্ক-সন্দেহ-সংশয়ের পেছনে একটি মনস্তাত্বিক কারণ সক্রিয় ছিল।
যারা বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসী এই পৃথিবীতে তাদের জীবনধারা হয় এক ধরনের আর যারা বিচার দিবসের প্রতি অবিশ্বাসী, তাদের জীবনধারা হয় ভিন্ন ধরনের। বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসীদের জীবনধারা হলো, তারা যে কোন কাজই করুন না কেন, তাদের প্রতিটি কথা ও কাজের পেছনে এই অনুভূতি সক্রিয় থাকে যে, আল্লাহর কাছে বিচার দিবসে জবাবদিহি করতে হবে। এই পৃথিবীতে তারা যা কিছুই বলছে এবং করছে, এসবের জন্য মহান আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন। সে যদি কোন অসৎ কথা বলে এবং কাজ করে তাহলে তাকে আল্লাহর দরবারে শাস্তি পেতে হবে। এই পৃথিবীর জীবনই শেষ নয়, মৃত্যুর পরের জীবনই হলো আসল জীবন। সেই জীবনে তাকে সফলতা অর্জন করতে হবে। এই অনুভূতি নিয়ে সে পৃথিবীর জীবনকে পরিচালিত করে।
আর যারা বিচার দিবসের প্রতি অবিশ্বাসী, পৃথিবীতে তাদের জীবনধারা হলো বল্‌গাহীন পশুর মতোই। তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আর এরা বলে, যখন আমরা মাটিতে মিশে একাকার হয়ে যাবো তখন কি আমাদের আবার নতুন করে সৃষ্টি করা হবে? (সূরা আস্‌ সাজ্‌দাহ্‌-১০)
অর্থাৎ এদের বিশ্বাস হলো, মৃত্যুর পরে আর কিছুই নেই। নির্দিষ্ট সময়ের পরে একদিন আমরা মৃত্যুবরণ করবো, যার যার নিয়ম অনুসারে আমাদের অন্তেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে, আমাদের দেহ যেসব উপকরণ দিয়ে নির্মিত হয়েছিল, সেসব উপকরণ এই পৃথিবীতেই যখন বিদ্যমান রয়েছে, তখন সেসব উপকরণ পৃথিবীতেই মিশে যাবে। কারো দরবারেও আমাদেরকে দাঁড়াতে হবে না এবং আমাদের কোন কর্ম বা কথা সম্পর্কে কারো কাছে কোন জবাবদিহি করতেও হবে না। বিচার দিবসের প্রতি অবিশ্বাসীদের এই অনুভূতির কারণে পৃথিবীতে এদের কথা ও কাজের ব্যাপারে কোন নিয়ম এরা অনুসরণ করে না। তার কথায় কার কি ক্ষতি হতে পারে, কে মনে আঘাত পেতে পারে এসব চিন্তা তারা করে না। নিজের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য এরা যে কোন কাজই করতে পারে। তার কাজের দ্বারা ব্যক্তি বা দেশ ও জাতি কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হলো, এ চিন্তা এদের মনে স্থান পায় না।
এদের একমাত্র চিন্তাধারা হলো, এই পৃথিবীর জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার জন্য যেসব উপকরণ প্রয়োজন, তা যে কোন কিছুর বিনিময়ে হলেও অর্জন করতে হবে। যৌন অনাচারের মাধ্যমে যদি প্রভূত অর্থ আমদানী করা যায়, তাহলে তা করতে কোন দ্বিধা এদের থাকে না। সুদের প্রচলন ঘটিয়ে, অশ্লীলতার প্রসার ঘটিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, মিথ্যা-শঠতা, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা ইত্যাদির মাধ্যমে যদি নিজের স্বার্থ অর্জিত হয়, তাহলে অবশ্যই তা করতে হবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটিই- জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করো। এই জীবন একবার হারালে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, সুতরাং জীবিত থাকাবস্থায় ভোগের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হবে। খাও দাও আর ফূর্তি করো- (ঊধঃ, উৎরহশ ধহফ ইব গধবৎৎু) এটার নামই হলো জীবন।
আল্লাহর বিধান মেনে নিয়ে বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে গেলেই পৃথিবীর জীবন হয়ে যাবে নিয়ন্ত্রিত। আল্লাহর বিধান বলছে, মানুষের প্রতিটি কথা রেকর্ড করা হচ্ছে এবং বলা কথা সম্পর্কে বিচার দিবসে জবাবদিহি করতে হবে অতএব হিসাব করে কথা বলতে হবে। আল্লাহর বিধান বলছে, যৌন অনাচারের মুখে লাগাম দিয়ে বিয়ের মাধ্যমে বৈধভাবে যৌবনকে ভোগ করতে হবে। অতএব ফুলে ফুরে ঘুরে বিচিত্র উপায়ে যৌবনকে আর ভোগ করা যাবে না। আল্লাহর বিধান বলছে, বৈধ উপায়ে অর্থোপার্জন করতে হবে- এতে যদি সংসারে টানাটানি দেখা দেয় তবুও অবৈধ উপার্জনের পথ অবলম্বন করা যাবে না। অতএব অবৈধভাবে উপার্জন বন্ধ হবে, ভোগ-বিলাসের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, কালো টাকার পাহাড় গড়ার রাস্তা বন্ধ হবে, অপরের স্বার্থে আঘাত হানার যাবতীয় পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
এক কথায় গোটা জীবনকে একটি নিয়মের অধীন করে দিতে হবে। তাহলে তো পৃথিবীতে যেমন খুশী তেমনভাবে চলা যাবে না, জীবনকেও ভোগ করা যাবে না। সুতরাং আল্লাহর ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস- এই মতবাদকে কোনক্রমেই মেনে নেয়া যাবে না এবং এই মতবাদ যেন দেশের বুকে প্রচার না হতে পারে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, এই মতবাদ দেশের বুকে প্রচার করতে দেয়া হলে, দেশের জনগণ ক্রমশঃ এই মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে, এই মতবাদে বিশ্বাসীদের দল ক্রমশঃ বৃদ্ধি লাভ করবে, তখন এদের চাপে বাধ্য হয়েই জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।
উল্লেখিত কারণেই নবী-রাসূলদের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে এবং সুদূর অতীত থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন যারা করছে, তাদের সাথে বিচার দিবস অস্বীকারকারীদের সাথে সংঘাত চলছে। বিচার দিবসকে যারা অস্বীকার করে তারা ভোগবাদে বিশ্বাসী। জীবনকে কানায় কানায় ভোগ করার প্রবণতাই এদেরকে বিচার দিবসের প্রতি অবিশ্বাসী করেছে। এই চিন্তাধারার অধিকারী ব্যক্তিগণই জীবনকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। জীবনের একভাগে থাকবে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে কোনক্রমেই ধর্ম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আর দ্বিতীয় ভাগে ব্যক্তি জীবনে যদি কেউ ধর্ম অনুসরণ করতে আগ্রহী হয়, তাহলে সে ব্যক্তিগতভাবে তা অনুসরণ করতে পারে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না আর এটারই নাম দেয়া হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। বিচার দিবসের প্রতি অবিশ্বাসের প্রবণতাই জন্ম দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ। নির্যাতন নি্‌ৌ৬৩৭৪৩;ষনের অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়েই ইসলামী আন্দোলন অগ্রসর হয়েছে এবং বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসীদের সংখ্যা এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, অবিশ্বাসীরা তখন প্রত্যক্ষভাবে বিশ্বাসীদের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি না করে শঠতা আর ধূর্ততার চোরা পথে এগিয়ে গিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ অনুসরণ করলে একদিকে যেমন জীবনকেও যথেচ্ছাভাবে ভোগ করা যাবে, অপরদিকে বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতি সক্রিয় রেখে যারা জীবন পরিচালিত করতে আগ্রহী, তারাও ব্যক্তিগত জীবনে তাদের আদর্শানুসারে চলতে পারবে। ফলে উভয় দলের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাতও দেখা দিবে না এবং ধর্মনিরপেক্ষতার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে দেশে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে, সেই পরিবেশই মানুষের অন্তর থেকে বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতি বিদায় করে দেবে। এভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারীরা নাস্তিক্যবাদকে বিকশিত করার ঘৃণ্য পথ অবলম্বন করে থাকে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ অন্যান্য নবী-রাসূলগণ যখন সত্য সঠিক পথ অবলম্বন করার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তোমরা যদি অন্যায় পথেই চলতে থাকো, তাহলে বিচার দিবসে আল্লাহর আদালতে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে। তখন তারা রাসূলের আহ্বানের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে নানা ধরনের ভিত্তিহীন যুক্তি প্রদর্শন করেছে। তাদের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এরা বলে, আমাদের প্রথম মৃত্যু ব্যতিত আর কিছুই নেই। এরপর আমাদের পুনরায় আর উঠানো হবে না। যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে আমাদের বাপ-দাদাদের জীবিত করে আনো। (সূরা আদ দুখান-৩৫-৩৬)
অর্থাৎ মানুষের জীবনে মৃত্যু বার বার আসে না- একবারই আসে। এই একবারেই মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় জীবনের কোন অস্তিত্ব নেই। যারা বিচার দিবসের কথা বলে, তারা যদি তাদের দাবিতে সত্যবাদী হয়, তাহলে আমাদের পূর্বে যারা এই পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেছে, তাদের ভেতর থেকে দু’চারজনকে উঠিয়ে নিয়ে এসে প্রমাণ করে দিক যে, মৃত্যুর পরেও আরেকটি জীবন রয়েছে।
এ ধরনের হাস্যকর যুক্তি শুধু সে যুগেই প্রদর্শন করা হয়নি, বর্তমান যুগেও তথাকথিত বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় জীবনের কোন অস্তিত্ব নেই। মূল বিষয় হলো সময়। সময় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, এই সময়ই মানুষকে ক্রমশঃ নিঃশেষের দিকে নিয়ে যায়। কালের গর্ভে সমস্ত কিছুই বিলীন হয়ে যায়। কালের অন্ধকার বিবরে একবার যা প্রবেশ করে তা পুনরায় ফিরে আসে না। মানুষ এক সময় শিশু থাকে, কালের বিবর্তনে এই শিশু একদিন বৃদ্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের যুক্তি তথাকথিত বিজ্ঞানের যুগেই দেয়া হচ্ছে না। যে যুগটিকে মূর্খতার যুগ (ঊটহ্র মত ধথভমরটভডণ) নামে অভিহিত করা হয়, সেই যুগেও একই যুক্তি প্রদর্শন করা হতো। তারা কি যুক্তি প্রদর্শন করতো, এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা শোনাচ্ছেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এরা বলে, জীবন বলতে তো শুধু আমাদের পৃথিবীর এই জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ব্যতীত আর কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করে না। (সূরা জাসিয়া-২৪)
বিচার দিবস সম্পর্কে যারা সন্দেহমূলক প্রশ্ন তোলে, তারা এ ধরনের বালখিল্য যুক্তি প্রদর্শন করে থাকে। মানুষ ইন্তেকাল করে এবং আর কোনদিন ফিরে আসে না, এটাই এদের কাছে বড় প্রমাণ যে, মৃত্যুর পরে আর দ্বিতীয় কোন জীবন নেই। ইন্তেকালের পরে মানুষের দেহ পচে যায়, মাটির সাথে গোস্ত মিশে যায়। রয়ে যায় হাড়গুলো, তারপর সে হাড়ও একদিন মাটির সাথে মিশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মানুষের আর কোনই অস্তিত্ব থাকে না। বিচার দিবসে বিশ্বাসীগণ যখন বলেন, মাটির মিশে যাওয়া অস্তিত্বহীন মানুষই বিচার দিবসে পুনরায় দেহ নিয়ে উত্থিত হবে, তখন এদের কাছে বিষয়টি বড় অদ্‌ভূত মনে হয়। বিস্ময়ে এরা প্রশ্ন করে, অস্তিত্বহীন মানুষ কি করে পুনরায় অস্তিত্ব লাভ করবে? এটা অসম্ভব! সুতরাং বিচার দিবস বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। এদের বলা কথাগুলো মহান আল্লাহ এভাবে কোরআনে পরিবেশন করেছেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
তারা বলে, আমরা যখন শুধুমাত্র হাড় ও মাটি হয়ে যাবো তখন কি আমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করে উঠানো হবে? (সূরা বনী ইসরাঈল-৪৯)
শুধু তাই  নয়, বিচার দিনের ব্যাপারটিকে তারা বিদ্রূপের বিষয়ে পরিণত করে থাকে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মানুষকে পরকালে জবাবদিহির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতেন, তখন তারা বলতো, লোকটি নিজে এ সম্পর্কে কথা রচনা করে তা আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে অথবা তার মাথা ঠিক নেই। কারণ মাথা ঠিক থাকলে সে কি করে বলে যে, মাটির সাথে হাড়-মাংস মিশে যাওয়া মানুষ পুনরায় নিজের অস্তিত্বে প্রকাশ হয়ে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করবে? এই লোকগুলো পথ চলতে যার সাথেই দেখা হতো, তার কাছেই রাসূল সম্পর্কে বিদ্রূপ করে যে কথাগুলো বলতো,  তা পবিত্র কোরআন এভাবে পেশ করেছে-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
অবিশ্বাসীরা লোকদেরকে বলে, আমরা কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলবো, যে ব্যক্তি এই ধরনের সংবাদ দেয় যে, যখন তোমাদের শরীরের প্রতিটি অণু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তখন তোমাদের নতুনভাবে সৃষ্টি করে দেয়া হবে, না জানি এই ব্যক্তি আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা করে, না কি তাকে পাগলামিতে পেয়ে বসেছে। (সূরা সাবা-৭-৮)

মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে কোরআনের যুক্তি

অবিশ্বাসীদের যুক্তি হলো, এ পর্যন্ত কোন মানুষ ইন্তেকাল করার পরে পুনরায় ফিরে আসার কোন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই, সুতরাং পরকালে মানুষকে পুনরায় জীবিত করো হবে, এ কথা কোনক্রমেই বিশ্বাস করা যায় না। তারা চ্যালেঞ্জ করে বলতো যে, যদি সত্যই বিচার দিবস নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে, সেদিন আল্লাহর আদালতে মৃত মানুষগুলো জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করার বিষয়টি সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পূর্বে যারা ইন্তেকাল করেছে, তাদের মধ্য থেকে যে কোন ব্যক্তিকে জীবিত করে এনে আমাদেরকে দেখাও- তাহলে আমরা বিশ্বাস করবো, বিচার দিবস বলে কিছু আছে। এদের এই দাবিই অপ্রাসঙ্গিক।
কারণ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর অনুসারীগণ বর্তমান সময় পর্যন্ত এমন কথা কখনো বলেননি যে, আমরা মৃত মানুষকে জীবিত করে দেখাতে পারি। ইশারা ইঙ্গিতেও তারা কখনো এ ধরনের অমূলক দাবি করেননি। তাহলে যে বিষয়ে কোন কথা বলা হয়নি বা দাবি করা হচ্ছে না, সে বিষয়কে কেন প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে? তাদের উদ্দেশ্য একটিই আর তাহলো, তারা বিচার দিবসকে মেনে নেবে না। বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার ইচ্ছে থাকলে তর্কের রীতি অনুসরণ না করে অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে আনা হতো না।
মৃতকে জীবিত যদি কেউ দেখতে আগ্রহী হয়, তাহলে কবরের মানুষুগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত না করে প্রথমে নিজের দেহের দিকে দৃষ্টিপাত করা উচিত। প্রতিদিন অসংখ্য দেহকোষ কিভাবে মৃত্যুবরণ করছে এবং কিভাবে নতুন দেহকোষ জীবিত হচ্ছে। প্রাণহীন ভ্রুণ থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ মানব শিশু জন্ম লাভ করছে। মানুষের জন্মের বিষয়টির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। এক বিন্দু নাপাক পানির মধ্যে এমন কি রয়েছে, যা চোখে দেখা যায় না। তা থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ একটি মানব শিশু প্রস্তুত হয়ে পৃথিবীতে আগমন করছে। ক্রমশঃ সেই শিশু একটি সুন্দর দেহধারী মানুষে পরিণত হচ্ছে। এভাবে মানব সৃষ্টির গোটা প্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে কি মৃত্যুর পরে জীবিত হওয়ার বিষয়টিকে অসম্ভব বলে মনে হয়? প্রাণী জগতের দিকে তাকালেও সেই একই বিষয় ধরা পড়ে। ডিমগুলোর মধ্যে প্রাণের কোন স্পন্দন নেই, অথচ সেই ডিম থেকে কিভাবে জীবিত বাচ্চা পৃথিবীতে বেরিয়ে আসছে।
চৈত্র মাসের খর-তাপে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। নদী-নালা-খাল-বিল-হাওড় শুকিয়ে মরুভূমির মতো হয়ে যায়। এক সময় যেখানে সবুজের সমারোহ ছিল, দৃষ্টি-নন্দন নৈসর্গিক দৃশ্য বিরাজিত ছিল। প্রচন্ড দাবদাহে সেখানে কোন মানুষের পক্ষে মুহূর্ত কাল দাঁড়ানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। যমীন প্রাণশক্তি হারিয়ে মৃত পতিত আকার ধারণ করে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করেন তারপর তা মেঘমালা উঠায় এরপর আমি তাকে নিয়ে যাই একটি জনমানবহীন এলাকার দিকে এবং মৃত-পতিত যমীনকে সঞ্জীবিত করে তুলি। মৃত মানুষদের জীবিত হয়ে ওঠাও তেমনি ধরনের হবে। (সূরা ফাতির-৯)
বিচার দিবস তথা পরকাল হবে কি হবে না, এ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য কোন গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। পদতলে নি্‌ৌ৬৩৭৪৩;ষিত দুর্বা ঘাসগুলোর দিকে তাকালেই অনুভব করা যায়। বিশেষ মৌসুমে এই ঘাসগুলো গালিচার মতোই হয়ে ওঠে। সৌন্দর্য পিয়াসী ব্যক্তিগণ নরম তুলতুলে এই ঘাসগুলোর ওপরে শুয়ে নীল আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করে। কবি, সাহিত্যিকদের কল্পনার বদ্ধ দুয়ার দ্রুত অর্গল মুক্ত হয়। আবার বিশেষ এক মৌসুমের আগমন ঘটে, তখন সেই সুন্দর ঘাসগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। যে স্থানে সবুজ ঘাসের নীল গালিচার ওপরে শুয়ে কবি একদিন তার কল্পনার বদ্ধ দুয়ার অর্গল মুক্ত করেছিল, সে স্থানে সবুজের কোন চিহ্ন থাকে না, রুদ্র প্রয়াগের তপ্ত নিঃশ্বাস আর মৃতের হাহাকার সেখানে ভেসে বেড়ায়।
এরপর মাত্র এক পশলা বৃষ্টি বর্ষিত হলো, তারপর মৃত-ভূমি অকস্মাৎ সবুজ শ্যামল আভায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো এবং দীর্ঘকালের মৃত শিকড়গুলো সবুজ চারাগাছে রূপান্তরিত হয়ে মাটির বুকে আবার বিছিয়ে দিল নমনীয় নীল গালিচা। দৃষ্টি বিমোহিত এই দৃশ্য দেখেও কি মনে হয়, মৃত মানুষকে পুনরায় আল্লাহর পক্ষে জীবন দান করা অসম্ভব? এসব কিছু দেখার পরেও বিচার দিবস সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকতে পারে? আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
হে মানব মন্ডলী ! যদি তোমাদের মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকে, তাহলে তোমরা জেনে রেখো, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে, তারপর রক্তপিন্ড থেকে, তারপর গোশ্‌তের টুকরা থেকে, যা আকৃতি বিশিষ্টও হয় এবং আকৃতিহীনও হয়। (এসব বর্ণনা করা হচ্ছে) তোমাদের কাছে সত্য সুস্পষ্ট করার জন্য। আমি যে শুক্রকে চাই একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত গর্ভাশয়ে স্থিত রাখি, তারপর একটি শিশুর আকারে তোমাদের বের করে আনি, (তারপর তোমাদের প্রতিপালন করি) যেন তোমরা পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে যাও। (সূরা হজ্জ-৫)
বিচার দিবসে কিভাবে মাটির সাথে মিশে যাওয়া মানুষগুলো পুনরায় জীবিত হবে, এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কারো মনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয় তাহলে তোমরা নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখো, তোমরা কি ছিলে। তোমাদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। এমন এক ফোটা পানি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করা হলো, যে পানি দেহ থেকে নির্গত হলে গোসল ফরজ হয়ে যায়। সেখানে তোমাদেরকে আমি অস্তিত্ব দান করেছি। তারপর তোমাদেরকে আমিই প্রতিপালন করে সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারী যুবকে পরিণত করি। এভাবে তোমাদেরকে আমি প্রথমবার যখন সৃষ্টি করেছি, তখন তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করা কি আমার পক্ষে অসম্ভব মনে করো? শুধু তাই নয়, অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে তোমাদেরকে আমিই সৃষ্টি করে মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর আকারে পৃথিবীতে এনে যুবকে পরিণত করি। এরপর তোমাদেরকে আমি কোন পরিণতিতে পৌঁছে দেই শোন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আর তোমাদের মধ্য থেকে অনেককেই তার পূর্বেই আমি ফিরিয়ে নিয়ে আসি এবং কাউকে হীনতম বয়সের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, যেন সবকিছু জানার পরেও আর কিছুই না জানে। (সূরা আল হাজ্জ-৫)
তোমাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না, সেখান থেকে অস্তিত্ব দান করলাম। তারপর তোমাদেরকে কৈশোর, যুবক ও বৃদ্ধাবস্থার দিকে নিয়ে যেতে থাকি। এভাবে নিয়ে যাওয়ার মধ্যস্থিত সময়ে অনেককেই আমি মৃত্যু দান করি। তোমরা কেউ কিশোর অবস্থায়, তরুণ বয়সে, যুবক বয়সে মৃত্যুবরণ করো। আবার কাউকে কাউকে আমি বয়সের এমন এক প্রান্তে পৌঁছে দেই, তখন সে নিজের শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোন যত্ন নেয়া দূরে থাক, সংবাদই রাখতে সক্ষম হয় না। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অন্যকে জ্ঞান বিতরণ করতো, সে বয়সের শেষ প্রান্তে পৌঁছে শুধু শিশুর মতো জ্ঞানহীনই হয়ে যায় না, একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে। যে ব্যক্তির এত পান্ডিত্য ছিল, জ্ঞান ছিল, নানা ধরনের বিদ্যা অর্জন করেছিল, বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে বিশেষজ্ঞ ছিল, কত অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা ছিল। তার এসব গর্বের বস্তুকে এমনই অজ্ঞতায় পরিবর্তিত করে দেই যে, একদিন তার কথা অসংখ্য জ্ঞানী মানুষ নিবিষ্ট চিত্তে মনোযোগ দিয়ে শুনতো, এখন তার কথা শুনলে ছোট্ট একটি শিশুও হাসে। কোথা থেকে তোমাদেরকে আমি কোন অবস্থায় নিয়ে আসি, তা দেখেও কি তোমরা বুঝো না, বিচার দিবসে তোমাদেরকে আমি একত্রিত করতে সক্ষম হবো? রাব্বুল আলামীন বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আর তোমরা দেখছো যমীন বিশুষ্ক পড়ে রয়েছে তারপর যখনই আমি তার ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করেছি তখনই সে সবুজ শ্যামল হয়েছে, স্ফীত হয়ে উঠেছে এবং সবধরনের সুদৃশ্য উদি্‌ভদ উ গত করতে শুরু করেছে। এসব কিছু এজন্য যে, আল্লাহ সত্য, তিনি মৃতদেরকে জীবিত করেন এবং তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী। আর এই (এ কথার প্রমাণ) যে, কিয়ামতের সময় অবশ্যই আসবে, এতে কwেন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে উঠবেন যারা কবরে চলে গিয়েছে। (সূরা আল হাজ্জ-৫-৭)
যারা বিচার দিবস সম্পর্কে সন্দেহ সংশয়ের আবর্তে দোলায়িত হচ্ছে, তাদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহ আছেন একথা অবশ্যই সত্য। মানুষ যখন মরে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে, তারপর তাদের আর জীবিত হবার কোনই সম্ভাবনা নেই- যারা এ ধারনা পোষণ করে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আল্লাহর অস্তিত্ব নিছক কাল্পনিক কোন বিষয় নয়। কোন বুদ্ধিবৃত্তিক জটিলতা পরিহার করার লক্ষ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব আবিষ্কার করা হয়নি।
তিনি নিছক দার্শনিকদের চিন্তার আবিষ্কার, অনিবার্য সত্তা ও সকল কার্যকারণের প্রথম কারণই নয় বরং তিনি প্রকৃত স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন কর্তা, যিনি সময়ের প্রতি মুহূর্তে নিজের অসীম শক্তিমত্তা, সংকল্প, জ্ঞান ও কলা-কৌশলের মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টিজগৎ এবং এর প্রতিটি বস্তু পরিচালনা করছেন। তিনি খেয়ালের বশে এসব কিছু সৃষ্টি করেননি। এসব সৃষ্টি করার পেছনে কোন শিশু সুলভ মনোভাবও কাজ করেনি যে, শিশুর মতো খেলা শেষ হলেই সমস্ত কিছুই ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ ধূলায় উড়িয়ে দেয়া হবে। বরং তিনি সত্য এবং তাঁর যাবতীয় কাজই গুরুত্বপূর্ণ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ। বিজ্ঞানের সুষমায় প্রতিটি সৃষ্টিই সুষমা মন্ডিত।
বিচার দিবসের প্রতি যারা সন্দেহ পোষণ করে, তারা যদি সৃষ্টি জগতের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে শুধু নিজের জন্মের প্রক্রিয়া নিয়ে সামান্য চিন্তা করে, তাহলে সে অবগত হতে পারবে যে, একজন মানুষের অস্তিত্বের ভেতরে মহান আল্লাহর প্রকৃত ও বাস্তব ব্যবস্থাপনা এবং বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশল প্রতি মুহূর্তে সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি মানুষের অস্তিত্ব, বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রত্যেকটি পর্যায়েই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের স্বেচ্ছামূলক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই স্থিরীকৃত হয়ে থাকে। অবিশ্বাসীরা বলে থাকে যে, এসব সৃষ্টির পেছনে কোন নিয়মতান্ত্রিক স্রষ্টা বলে কেউ নেই। যা ঘটছে তা একটি প্রাকৃতিক নিয়মের অধিনেই ঘটছে।
পক্ষান্তরে এই হতভাগারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখতে পাবে যে, প্রতিটি মানুষ যেভাবে অস্তিত্ব লাভ করে এবং তারপর যে প্রক্রিয়ায় অস্তিত্ব লাভের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে, তার ভেতরে একজন সুবিজ্ঞ, মহাবিজ্ঞানী ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী প্রচন্ড শাক্তিশালী সত্তার ইচ্ছামলূক সিদ্ধান্ত কিভাবে সুপরিকল্পিত পন্থায় সক্রিয় রয়েছে। মানুষের গ্রহণকৃত খাদ্যের মধ্যে কোথাও মানবিক বীজ গোপন থাকে না যা মানবিক প্রাণের বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে সক্ষম। গ্রহণকৃত খাদ্য উদরে প্রবেশ করে কোথাও গিয়ে রক্ত, কোথাও গিয়ে হাড়, কোথাও গিয়ে গোশ্‌তে পরিণত হয়। আবার বিশেষ স্থানে তা পৌঁছে গ্রহণকৃত সেই খাদ্যই এমন শুক্রে পরিণত হয়, যার ভেতরে যাবতীয় বৈশিষ্ট্যসহ মানুষের পরিণত হবার যোগ্যতার অধিকারী বীজ লুকায়িত থাকে। এই লুকায়িত বীজের সংখ্যা এতটা অধিক যে, একজন পুরুষ থেকে প্রতিবারে যে শুক্র নির্গত হয় তার মধ্যে কয়েক কোটি শুক্রকীট অবস্থান করে এবং তার প্রতিটি নারীর ডিম্বাণুর সাথে মিশে মানুষের রূপ লাভ করার যাবতীয় যোগ্যতা ধারণ করে। কিন্তু একজন মহাবিজ্ঞানী, অসীম শক্তিশালী একচ্ছত্র সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন শাসকের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সেই অসংখ্য শুক্রকীটের মধ্য থেকে মাত্র একটিকে নির্বাচিত করে নারীর ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হবার সুযোগ করে দেয়া হয়। এভাবে চলে গর্ভধারণ প্রক্রিয়া এবং গর্ভধারণের সময় পুরুষের শুক্রকীট ও নারীর ডিম্বকোষের মিলনের ফলে প্রাথমিক অবস্থায় এমন একটি জিনিস অস্তিত্ব লাভ করে এবং সেটা এতই ক্ষুদ্র যে, তা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতিত চোখে দেখা সম্ভব নয়।
সেই ক্ষুদ্র জিনিসটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গর্ভাশয়ে প্রতিপালিত হয়ে বেশ কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে অপূর্ব সুন্দর একটি দেহ কাঠামো ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ একটি মানুষে পরিণত হয়। মানুষের জন্মের প্রতিটি জটিল স্তরের বিষয়টি সম্পর্কে কেউ চিন্তা করলেই তার মন-মস্তিষ্ক দ্বিধাহীন চিত্তে দৃঢ়ভাবে সাক্ষী দেবে যে, এসব বিষয়ের ওপরে প্রতি মুহূর্তে একজন সদা তৎপর মহাবিজ্ঞানীর ইচ্ছামূলক সিদ্ধান্ত সঠিক পন্থায় কাজ করছে। সেই সুবিজ্ঞ মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ তা’য়ালাই সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, কোন মানুষকে তিনি পূর্ণতায় পৌঁছাবেন, কাকে তিনি ভ্রুণ অবস্থাতেই শেষ করে দিবেন, কাকে তিনি গর্ভে দেহ কাঠামো দেয়ার পরে শেষ করবেন, কাকে তিনি পৃথিবীতে আসার পরে প্রথম নিঃশ্বাস গ্রহণের সুযোগ দেবেন অথবা দেবেন না।
মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্যেই তিনিই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, কাকে তিনি জীবিত নিয়ে আসবেন আর কাকে তিনি মৃত নিয়ে আসবেন। কাকে তিনি মাতৃগর্ভ থেকে সাধারণ মানুষের আকার আকৃতিতে বের করে আনবেন, আবার কাকে তিনি অস্বাভাবিক কোন আকার দিয়ে পৃথিবীতে আনবেন। কাকে তিনি সুন্দর অবয়ব দান করে আনবেন অথবা কুৎসিত অবয়ব দান করে পৃথিবীর আলো-বাতাসে নিয়ে আসবেন। কাকে তিনি পূর্ণাঙ্গ মানবিক অবয়ব দান করবেন অথবা বিকলাঙ্গ করে আনবেন। কাকে তিনি পুরুষ হিসাবে আনবেন অথবা কাকে তিনি নারী হিসাবে আনবেন। কাকে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার মতো যোগ্যতা দিয়ে আনবেন, অথবা কাকে তিনি একেবারে নির্বোধ-বোকা হিসাবে পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন।
মানুষের সৃজন ও আকৃতিদানের এসব প্রক্রিয়া সময়ের প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর অসংখ্য নারীর গর্ভাশয়ে বিরামহীন গতিতে সক্রিয় রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার ভেতরে কোন একটি পর্যায়েও একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত পৃথিবীর কোন একটি শক্তিও সামান্যতম প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ নয়। এসব অসম্ভব প্রক্রিয়া দেখেও কেউ যদি বলে যে, বিচার দিবসে মানুষকে পুনরায় জীবনদান করা অসম্ভব ব্যাপার- তাহলে তাকে হতভাগা ও নির্বোধ ব্যতিত আর কোন বিশেষণে বিশেষিত করা যেতে পারে ?
মহান আল্লাহ মৃতদেরকে জীবিত করবেন, এ কথা শুনে অবাক হবার কিছুই নেই। প্রতিটি বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই স্পষ্ট অনুভব করা যায় যে, আল্লাহ তা’য়ালা কোন প্রক্রিয়ায় মৃতকে জীবিত করছেন। এখানে পুনরায় বলতে হচ্ছে, গ্রহণকৃত খাদ্যের যেসব উপাদান দ্বারা মানুষের দেহ গঠিত হচ্ছে এবং যেসব উপকরণ দ্বারা সে প্রতিপালিত হচ্ছে, সেসব উপায়-উপকরণসমূহ বিশ্লেষণ করলে নানা ধরনের পদার্থ ও অন্যান্য উপাদান পাওয়া যাবে কিন্তু জীবন ও মানবাত্মার কোন বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব তার ভেতরে পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে এসব মৃত, নির্জীব উপায়, উপকরণগুলোর সমাবেশ ঘটিয়েই মানুষকে একটি জীবিত ও প্রাণের স্পন্দন সম্বলিত অস্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে। তারপর নানা উপাদান সম্বলিত খাদ্য মানুষের শরীরে পরিবেশন করা হয় এবং দেহের অভ্যন্তরে গ্রহণকৃত খাদ্যের নির্যাসের সাহায্যে পুরুষের মধ্যে এমন শুক্রকীট এবং নারীর মধ্যে এমন ডিম্বকোষের সৃষ্টি হয়, যাদের মিলিতরূপে প্রতি মুহূর্তে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত মানুষ প্রস্তুত হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসে বের হয়ে আসছে।
আল্লাহ তা’য়ালা কিভাবে মৃত থেকে জীবিত বের করেন, মানুষ দেখতে পারে তার চার পাশের পরিবেশের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে। বাতাস, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী অসংখ্য উদি্‌ভদের বীজ ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে রাখে। নানা ধরনের উদি্‌ভদের মূল মাটির সাথে মিশে ছিল। এসবের মধ্যে উদি্‌ভদ জীবনের সামান্যতম লক্ষণও বিদ্যমান ছিলনা। এসব বীজ ও মূল যেন কবরে প্রথিত রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনুগ্রহ করে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। ওমনি উদি্‌ভদের নি্‌ৗ৬৩৭৪৩;্রাণ বীজ আর বৃক্ষমূলগুলো মাটির কবর থেকে চারাগাছ রূপে মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করলো। মৃতকে জীবিত করার এই দৃষ্টি নান্দনিক দৃশ্য- এসব দেখেও যারা মনে করে, বিচার দিবসে আল্লাহর পক্ষে মৃত মানুষদেরকে জীবিত করা অসম্ভব, তাদেরকে চোখ-কান থাকার পরেও অন্ধ-বধির বিশেষণে বিশেষিত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় থাকে না।
সৃষ্টিজগতের এসব নিদর্শনই বলে দিচ্ছে যে, মহান আল্লাহ অসীম শক্তিশালী এবং সেই শক্তির সামান্য অংশ প্রয়োগ করেই তিনি বিচার দিবসে মৃতদেরকে জীবিত করবেন। উদি্‌ভদের জীবনধারার মধ্যে আল্লাহ তা’য়ালার মক্তিমত্তার যে অভাবনীয় কর্মকুশলতা দেখা যায়, সেগুলো দেখার পর কি কোন জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি এ কথা বলতে পারে যে, সৃষ্টিজগতে এ পর্যন্ত যেসব কর্ম আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্পাদন করা হয়েছে এবং হচ্ছে, আল্লাহ এসবের বাইরে আর কোন নতুন কর্ম সম্পাদন করতে অক্ষম?
এ ধরনের অবাঞ্ছিত ধারণা আল্লাহ সম্পর্কে যারা করেন, তাদের কাছে আমরা বিনয়ের সাথে নিবেদন করতে চাই, মানুষের সম্পর্কে স্বয়ং মানুষের ধারণা আজ থেকে মাত্র এক শতাব্দী বা পঞ্চাশ বছর পূর্বে কেমন ছিল? বা্‌ৗ৬৩৭৪৩; ইঞ্জিন আবিষ্কারের পূর্বে এই মানুষ ধারণা করতে সক্ষম হয়নি যে, তারা এরচেয়ে বড় কোন কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। অথচ তারা ঐ বা্‌ৗ৬৩৭৪৩; ইঞ্জিনের থেকেও লক্ষ কোটি গুণে কার্যোপযোগী যন্ত্রযান নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯৭ সনে আমি যখন লন্ডন সফর করি তখন সেখানের কিছু লোকজন আমাকে এমন একটি ডিজিটাল ডায়েরী দিয়েছিল, যার ভেতরে অসংখ্য তথ্য সংরক্ষণ করা ছাড়াও হাজার হাজার টেলিফোন নম্বর সংরক্ষণ করা যায়। এই ধরনের ডায়েরী মানুষ আবিষ্কারে সক্ষম হবে, এ কথা তারা মাত্র কিছুদিন পূর্বেও কল্পনা করতে পারেনি। মানুষ কম্পিউটার আবিষ্কার করেছে। এই কম্পিউটারের ভেতরে গোটা পৃথিবীর অসংখ্য তথ্য সংরক্ষণ করা যায়। এভাবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে মানুষ যে উন্নতি করছে, কিছুদিন পূর্বেও মানুষ এসব বিষয় সম্পর্কে কল্পনা করতে সক্ষম হয়নি। মহাশূন্য যান সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণা ছিল না। অথচ বর্তমানে তা কঠিন বাস্তবতা এবং এসব দেখে মানুষ আর বিস্ময়বোধ করে না। সীমিত ক্ষমতার অধিকারী মানুষের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে যখন কোন সীমা নির্ধারণ করা যায় না, অথচ এই মানুষ কি করে সেই অসীম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর কর্ম ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলে যে, মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবন দেয়া আল্লাহর পক্ষে সম্ভব নয় এবং বিচার দিবসে তিনি সমস্ত মানুষকে একত্রিত করতে পারবেন না? তিনি এ পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, এসবের থেকে অন্য কিছু নতুন করে সৃষ্টি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়?
অথচ সৃষ্টিজগতের প্রতিটি সৃষ্টির নিপুণতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঘোষণা করছে যে, তিনি অসীম ক্ষমতা ও বিজ্ঞতার অধিকারী। তিনিই মানুষকে হাসিয়ে থাকেন আবার তিনিই মানুষকে কাঁদিয়ে থাকেন। জীবন ও মৃত্যুর বাগডোর একমাত্র তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আর এই যে, তিনিই মানুষকে আনন্দানুভূতি দিয়েছেন এবং তিনিই দুঃখানুভূতি দিয়েছেন। তিনিই মৃত্যু দিয়েছেন এবং তিনিই জীবনদান করেছেন। তিনিই পুরুষ ও স্ত্রীর জোড়া সৃষ্টি করেছেন, এক ফোটা শুক্র থেকে যখন তা নিক্ষিপ্ত হয়। দ্বিতীয়বার জীবনদান করাও তাঁরই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তিনিই ধনী বানিয়েছেন এবং বিষয়-সম্পত্তি দান করেছেন। (সূরা নাজ্‌ম-৪৮)
নিত্য নতুন নানা ঘটনা আল্লাহ তা’য়ালা ঘটিয়ে চলেছেন। পত্র-পত্রিকায় মাঝে মধ্যে সংবাদ পরিবেশিত হয়, মানুষ চোখেও দেখে থাকে, মাতৃগর্ভের গর্ভাশয়ে একসাথে পাঁচটি দশটি পর্যন্ত সন্তান আল্লাহ দান করে থাকেন। এসব দেখেও মানুষ কি করে ধারণা করে, নতুনভাবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্ব-ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারবেন না? আল্লাহ তা’য়ালা প্রশ্ন করছেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
তোমরা আল্লাহর সাথে কি করে কুফুরীর আচরণ করতে পারো? অথচ তোমরা প্রাণহীন ছিলে, তিনিই তোমাদেরকে জীবনদান করেছেন। তারপর তিনিই তোমাদের প্রাণ হরণ করবেন এবং পুনরায় তিনিই তোমাদেরকে জীবনদান করবেন। অবশেষে তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। (সূরা বাকারা-২৮)
মানুষ মৃত্যুর পরের জীবন তথা বিচার দিবস সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে, এ জন্য তিনি পৃথিবীতেই মৃত্যুর পরে জীবনদানের প্রক্রিয়া সংঘটিত করেছেন, যেন মানুষের মনে কোন ধরনের সন্দেহ-সংশয় দানা বাঁধতে না পারে। অস্তিত্বহীন মানুষকে তিনি অস্তিত্ব প্রদান করেছেন, আবার তিনিই তাকে মৃত্যুদান করবেন। আবার তিনিই পুনরায় জীবনদান করে বিচার দিবসে একত্রিত করবেন। কিভাবে করবেন, তিনি তা মানুষকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এ কথা ভালোভাবে জেনে নাও যে, পৃথিবীর এই মৃত যমীনকে তিনিই জীবনদান করেন। (সূরা হাদীদ- ১৭)
পৃথিবীতে মানুষের চোখের সামনে মৃত জিনিসগুলোকে পুনরায় জীবনদান করে মানুষকে দেখানো হয়, এভাবেই তিনি বিচার দিবসে মানুষকে পুনরায় জীবনদান করবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কর্মগুলোকে শক্তিমত্তার দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মন সাক্ষী দেয় যে, তিনি যখনই ইচ্ছা করবেন, তখনই সমস্ত মৃতকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম। ইতিপূর্বে যাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না, তাদেরকে তিনি অস্তিত্ব দান করেছেন। অপরদিকে আল্লাহর কাজগুলোকে যদি তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে বুদ্ধিবৃত্তি সাক্ষী দেয় যে, তিনি মানুষকে পুনরায় জীবনদান করে হিসাব গ্রহণ করবেন।
মানুষ যে সীমিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করেছে এর অনিবার্য ফল হিসাবে দেখা যায় যে, তারা যখনই নিজের অর্থ-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য অন্য কারো হাতে সোপর্দ করে দেয়, তখন এমনটি কখনো ঘটে না যে, সে কোন হিসাব গ্রহণ করে না। কারো কাছে কোন কিছু সোপর্দ করলে সে তার পূর্ণ হিসাব গ্রহণ করে। পিতা তার সন্তানের পেছনে অর্থ ব্যয় করে সন্তান যেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। সন্তান কোন কারণে তা অর্জন করতে ব্যর্থ হলে পিতা তাকে বলে, এবার হিসাব দাও- তোমার পেছনে আমি এত কষ্ট করে যে অর্থ ব্যয় করলাম, তা কোন কাজে লাগলো ? ব্যবসা করার জন্য অর্থ প্রদান করে পিতা দেখতে থাকেন, তার সন্তান কতটা সফলতা অর্জন করলো বা ব্যর্থ হলো।
অর্থাৎ আমানত ও হিসাব-নিকাশের মধ্যে যেন একটি অনিবার্য যৌক্তিক সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের সীমিত জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা কোন অবস্থাতেও এ সম্পর্ক উপেক্ষা করতে পারে না। এই জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতেই মানুষ ইচ্ছাকৃত কর্ম ও অনিচ্ছাকৃত কর্মের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। আবারা ইচ্ছাকৃত কর্মের সাথে নৈতিক দায়-দায়িত্বের ধারণা ওৎপ্রোতাভাবে জড়িত এবং তা কল্যাণ ও অকল্যাণের পার্থক্য নির্দেশ করে। কল্যাণমূলক কর্মের পরিসমাপ্তিতে সে প্রশংসা ও পুরস্কার লাভ করতে আগ্রহী হয় এবং অকল্যাণমূলক কর্মের শেষে উপযুক্ত প্রতিফল দাবি করে। এই উদ্দেশ্য সাধন করার লক্ষ্যে মানুষ আবহমান কাল থেকে পৃথিবীতে একটি প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থাও রচিত করেছে।
সৎকর্মের পুরস্কার ও অসৎকর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করতে হবে- এই ধারণা যে আল্লাহ মানুষের মস্তিষ্কে দান করেছেন, স্বয়ং সেই আল্লাহ সৎকর্মের পুরস্কার ও অসৎকর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করার ধারণা হারিয়ে ফেলেছেন, এ কথা কি কোন নির্বোধেও বিশ্বাস করবে? বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশলে পরিপূর্ণ সৃষ্টি এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু মানুষের অধীন করে দিয়েছেন, পৃথিবীর যাবতীয় উপায়-উপকরণ মানুষের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছেন- বিপুল ক্ষমতা লাভ করে মানুষ এসব কোন পন্থায় কিভাবে কোন কাজে ব্যবহার করলো, আল্লাহ এসব সম্পর্কে কোন হিসাব গ্রহণ করবেন না, এ কথা কি কোন সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে? সামান্য পূঁজি বিনিয়োগ করে মানুষ যদি বার বার হিসাব গ্রহণ করে, হিসাবে যদি দেখতে পায় যে, যার হাতে পূঁজি দেয়া হয়েছিল, সে সফলতা অর্জন করেছে। তখন তাকে পূঁজি বিনিয়োগকারী পুরস্কার দান করে। আর যদি হিসাব করে দেখে যে, বিনিয়োগকৃত পঁূজির অপব্যবহার করা হয়েছে, তখন তাকে শাস্তি প্রদান করে। এটা যদি মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে, তাহলে পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু আল্লাহ মানুষের হাতে অর্পণ করার পরে তা কিভাবে মানুষ ব্যবহার করলো, এ সম্পর্কে তিনি কোন হিসাব গ্রহণ করবেন না, এ কথা কি বিশ্বাস করা যায়?
আল্লাহ তা’য়ালা নিজের এতবড় বিশাল পৃথিবীর সাজ-সরঞ্জাম ও ব্যাপক ক্ষমতা সহকারে মানুষের হতে সোপর্দ করার পর তিনি হিসাব গ্রহণ করার কথা কি ভুলে গিয়েছেন? মানুষ অসৎ কর্ম সম্পাদন করে অর্থ আর প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে পৃথিবীর আইনের চোরাগলি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, কোন শাস্তি তাকে প্রদান করা যায়নি, কখনো কোনদিন তাকে এ ব্যাপারে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য কোন আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে না, এ কথা কি মেনে নেয়া যায় ? মানুষের চোখের সামনে পরিদৃশ্যমান যাবতীয় বস্তু এ কথারই সাক্ষী দিচ্ছে যে, সবকিছুর পরিসমাপ্তিতে আরেকটি জগৎ সৃষ্টি হতেই হবে এবং সেখানে মানুষের যাবতীয় কথা ও কর্ম সম্পর্কে মানুষ জিজ্ঞাসিত হবে। মানুষ তার কর্ম সম্পর্কে ভুলে যায় যে, সে অতীতে কি করেছে। তার ভুলে যাওয়া কর্ম সম্পর্কে সেদিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
সেদিন আল্লাহ তা’য়ালা এদের সবাইকে পুনরায় জীবিত করে উঠাবেন এবং তারা যা কিছু করে এসেছে তা তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। তারা তো ভুলে গিয়েছে (নিজেদের কর্ম সম্পর্কে), কিন্তু আল্লাহ তাদের যাবতীয় কৃতকর্ম গুণে গুণে সংরক্ষিত করেছেন। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের ব্যাপারে সাক্ষী। (সূরা মুজাদালা-৬)
বিচার দিবসে মানুষ যা করেছে, তাই তার সামনে পেশ করা হবে। এ ব্যাপারে কোন হ্রাস-বৃদ্ধি করা হবে না। মানুষের কর্মই নির্ধারণ করবে তার ভবিষ্যৎ। তারই কর্মই তার জন্য স্থান নির্বাচন করবে। মানুষ নিজের হাতে যা উপার্জন করেছে, তার ভিত্তিতেই আল্লাহ তা’য়ালা সেদিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কাউকে তিনি অযথা অভিযুক্ত করবেন না। মহান আল্লাহ বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এ হচ্ছে তোমার ভবিষ্যৎ, যা তোমার হাত তোমার জন্য প্রস্তুত করেছে, আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি যুলুম করেন না। (সূরা আল হাজ্জ-১০)

মুহূর্তে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটবে

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার অগণিত সৃষ্টির মধ্যে এমন এক অদৃশ্য শক্তি যার নাম মধ্যকার্ষন-অভিকর্ষণ শক্তি সৃষ্টি করেছেন। যে শক্তি আমরা চোখে দেখতে পাই না কিন্তু অনুভব করি। পৃথিবীর আকার আয়তন যত বড় তার চেয়েও আকার আয়তনে বড় ওই সূর্য, আবার যে সমস্ত তারকা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই, তা ওই সূর্যের চেয়েও বড় আবার যে সমস্ত তারকার আলো এ পর্যন্ত পৃথিবীর এসে পৌঁছেনি, ওই সমস্ত তারকা আরো বড়। এক অদৃশ্য শক্তির কারণেই ওই সমস্ত তারকা, গ্রহ, নক্ষত্র যার যার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে। কিয়ামতের দিন ওই অদৃশ্য শক্তি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিষ্ত্র্নিয় করে দেবেন। ফলে সমস্ত তারকা, গ্রহ, নক্ষত্র নিজের কক্ষচূøত হয়ে যাবে। সংঘর্ষ ঘটবে একটির সাথে অপরটির। ফলে সমস্ত কিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। মধ্যাকর্ষণ শক্তি নিষ্ত্র্নিয় করে দেয়ার ফলে পৃথিবীর সমস্ত কিছু তুলার মতো ভেসে বেড়াবে। তখন একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষ ঘটে বিকৃত হয়ে অবশেষে তা ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। এ ঘটনা ঘটবে মুহূর্তের মধ্যে। কিয়ামত সংঘটিত হতে কতটুকু সময় লাগবে সে ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
মহাধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হতে কিছুমাত্র বিলম্ব হবে না। শুধু এতটুকু সময় মাত্র লাগবে, যে সময়ের মধ্যে চোখের পলক পড়ে বা তার চেয়েও কম। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ সব কিছু করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান। (নাহ্‌ল-৭৭)
কোন প্রক্রিয়ায় সেই মহাধ্বংসযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেছেন-
আরবী,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আর সেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। সাথে সাথে আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে তা সমস্তই মরে পড়ে থাকবে। তবে আল্লাহ যাদের জীবিত রাখতে ইচ্ছুক তারা ব্যতীত। (সূরা যুমার-৬৮)