Tuesday, July 15, 2014

প্রিয়নবীর মানবিকতা ও আমাদের জীবন

প্রিয়নবীর মানবিকতা ও আমাদের জীবন

Sirat 02
খন্দকার মনসুর আহমদ :
মানবতাকে শান্তি ও মুক্তির আলোকিত পথের সন্ধান দিতে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হযরত আদম আ. হতে যে মানবতার উদ্বোধন ঘটেছিলো তা সর্বোচ্চ উৎকর্ষে পৌঁছে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে তাঁর আগমনের মধ্য দিয়েই।
কোনো মতাদর্শের কালজয়ী সাফল্যার্জন তখনই সম্ভব হয়ে থাকে, যখন সে আদর্শের অগ্রপথিক আগে নিজ জীবনে সে আদর্শের যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। স্বীকৃত সত্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপন জীবনে তাঁর প্রচারিত আদর্শের যথাযথ ও চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছিলেন। আর তাই তাঁর প্রচারিত আদর্শ ও দীন মানবতার হৃদয়ে রেখাপাত করে সমুদ্রের উত্তাল ঊর্মিমালার উচ্ছলতায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সর্বত্র।
যুগে যুগে মুসলিম-অমুসলিম গবেষক, পণ্ডিত অনুসন্ধিৎসার আলোকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। আজও দেখছেন। অনুসন্ধানের পর তাবৎ সুস্থ বিবেক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম চরিত্র বলে অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই চরিত্রের অনুসরণ মানব স্বভাবের একান্ত দাবি। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা নবীজীর সেই বর্ণিল জীবনের কতিপয় মহান ঘটনা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। সেসব ঘটনায় প্রিয়নবীর সেই সর্বোত্তম মানবিক আখলাকের চমৎকার রূপায়ন ঘটেছে।
ক্ষমা ও উদারতা
১. মুক্তির নবী প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনা হিজরতের প্রাক্কালে কাফিরদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তক্রমে ঘোষিত হলো যে, মুহাম্মদকে হত্যাকারীর পুরস্কার একশত উট। প্রিয়নবীর সন্ধানে খোলা তলোয়ার হাতে চতুর্দিকে বেরিয়ে পড়লো কাফিরদের কয়েকটি দল। সুরাকা ইবনে মালিক পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চললো প্রিয়নবীর পথ ধরে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের উদ্দেশ্যে সঙ্গী আবু বকর রা.-কে নিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। সুরাকা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে ফেললো। কাছাকাছি চলে এলে তাঁর ঘোড়া প্রচণ্ড হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। কিন্তু সুরাকা দমবার পাত্র নয়; সে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধরতে উদ্যত হলো। এবার এতো কাছে পৌঁছে গেলো যে, নবীজীর কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পেলো। আবু বকর রা. কেঁদে ফেললেন, নবীজী তাঁকে অভয় দিলেন। সুরাকা তারপর খুব কাছে চলে এলো, এমন সময় নবীজীর দু’আয় মরুভূমির শক্ত জমিনে তার ঘোড়ার পা গেড়ে গেলো। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সে তার অশ্ব উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে নবীজীর কাছে দোয়ার অনুরোধ জানালে নবীজী তার অশ্ব উদ্ধারের জন্য দু’আ করেন। নবীজীর এহেন ক্ষমা ও মহত্ত্বে সুরাকার হৃদয়রাজ্যে এক নতুন বিল্পব শুরু হয়। কিছুকাল পরে সে ইসলামের চিরস্নিগ্ধ ছায়ায় আশ্রয় নেয়।১
২. হুবার বিন আসওয়াদ নামের এক ব্যক্তি ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রু ছিলো। অসংখ্য যুদ্ধে মুসলমানদেরকে রক্তাক্ত করেছে সে। এছাড়া তার সবচেয়ে বড়ো অপরাধ ছিলো সে প্রিয়নবীর কলিজার টুকরো
কন্যা হযরত জয়নবকে আঘাত করে উট থেকে ফেলে দিয়েছিলো। সে আঘাতেই কিছুদিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন।
মক্কা বিজয়ের পর হুবারের প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হলো, তখন নাঙ্গা তলোয়ার হাতে মুসলিম বীরগণ তাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। হুবার বিন আসওয়াদ পালিয়ে যাবার অনেক ফন্দি এঁটে ব্যর্থ হলো। নিরুপায় হয়ে সে হযরত রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে ক্ষমা চাইলো। এতো কালের অপরাধী প্রিয়নবীর সামনে উপস্থিত। উদারতার মূর্ত প্রতীক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সরল মনে ক্ষমা করে দিলেন। সাথে সাথে সে পড়ে নিলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’২
৩. মক্কা বিজিত হলো। মুসলমানদের দাপটে প্রকম্পিত চারদিক। মুসলমানদের দুশমনদের অন্যতম নেতা সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া সমুদ্রপথে পালিয়ে ইয়ামান চলে যাওয়ার জন্য জেদ্দায় গিয়ে আত্মগোপন করলো। উমাইর ইবনে ওয়াহাব নবীজীর খেদমতে গিয়ে আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের গোত্রপতি সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া  সমুদ্রপথে পালিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছেন।’ রহমতের নবীর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলোÑ ‘তাঁকে আমি নিরাপত্তা দিলাম।’ উমাইর পুনরায় আরজ করলেন, ‘নিরাপত্তার কোনো নিদর্শন দিলে বোধ হয় বিষয়টি তাঁকে নিশ্চিত করতো।’ নবীজী তাঁর পাগড়ি খুলে দিয়ে দিলেন। উমাইর গিয়ে সাফওয়ানকে খুলে বললেন সবকিছু। তবুও সম্পূর্ণ শঙ্কামুক্ত হয় না সাফওয়ানের মন। এই সেই সাফওয়ান যে একদিন উমাইরকে নিযুক্ত করেছিলো রহমতের নবীকে হত্যা করার জন্য। সারাজীবন কতো আঘাতে আঘাতে সে ব্যথিত করেছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হৃদয় মুবারক। সে সাফওয়ানকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাবিজয়ের এ মহাবিজয়ের মুহূর্তেও শাস্তি না দিয়ে নিশর্তভাবে ক্ষমা করে দিলেন। বিষয়টি একটু বিস্ময়কর ঠেকলো তার কাছে।
এরপর দ্বিধাসংশয়ের দোলায় দুলতে দুলতে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া হাজির হলো মক্কার নতুন অধিপতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে। এসেই প্রথমে ভীতিমিশ্রত কণ্ঠে আরজ করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, উমাইর বলে, আপনি নাকি আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন?’ জবাব এলো, ‘হ্যাঁ, সে সত্যিই বলেছে।’ সাফওয়ান পুনরায় নিবেদন করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে দু’মাসের সময় দিন।’ নবীজী বললেন, ‘ তোমাকে দু’মাস নয়, চার মাসের সময় দেয়া হলো।’
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন উদারতায় সাফওয়ানের হৃদয় গলে গেলো। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠলো তাঁর মন। দ্বিধা ও সংশয়ের বুকে আঘাত হেনে সে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। এরপর ইসলামের চিরস্নিগ্ধ ছায়ায় আশ্রয় নিতে দেরি হলো না তার।৩
এ হলো রাজনৈতিক জীবনে প্রিয়নবীজীর ক্ষমা ও উদারতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত। আমাদের রাজনৈতিক জীবনে সে মানবিক আদর্শের বড়ো অভাব আজ।
আজ আমাদের ভাবতে হবে, আবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই মহান আদর্শকে আমাদের জীবনে সর্বতোভাবে প্রতিফলিত করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করতে হবে।
ধৈর্য ও সহনশীলতা
১. একবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ইহুদির কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ে মূল্য পরিশোধের চুক্তিতে কোনো বস্তু ক্রয় করেছিলেন। কয়েকদিন পর সময়সীমা অতিক্রান্ত না হতেই হঠাৎ একদিন ইহুদি এসে হাজির। এসেই সে মূল্য পরিশোধের জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর টেনে ধরে কঠোর ভাষায় তাঁর প্রতি অশোভন বাক্যবাণ ছুঁড়তে লাগলো। ব্যঘ্রসেনা উমর রা. কাছেই ছিলেন। ক্রোধে তাঁর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে কেবল, রাগত কণ্ঠে সবিস্ময়ে বলে উঠলেনÑ রে পামর! তুই সত্যি সত্যি তাই বলেছিস আমি যা শুনেছি!’ এই বলে তিনি ইহুদিকে ধরতে উদ্যত হলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উমরকে নিবৃত্ত করলেন। বললেন, ‘এতো পাওনাদার এর কথা বলার অধিকার আছে।’
কিছুক্ষণ পর ইহুদি তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করলো। বিনীত কণ্ঠে নিবেদন করলো, আমি একজন ইহুদি যাজক। তাওরাতে আখেরি নবীর পরিচয় পেয়েছি। তিনি অস্বাভাবিক ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অধিকারী হবেন, ইনি সত্যিই সে হক নবী কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য এ হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েছি। এরপর নবীজীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করে নিলো।
২. হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিতÑ একবার এক মরুবাসী বেদুঈন এসে বললো, ‘তোমার কাছে যেসব মাল আছে এগুলি তোমারও নয় তোমার বাবারও নয়, এখন আমার দু’টি উট বোঝাই করে মাল দিয়ে দাও। কারণ এসব মাল হচ্ছে আল্লাহর, আর আমি আল্লাহর বান্দা।’ তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি যে আচরণ করেছো, এজন্য তোমার মোটেও ভয় হচ্ছে না?’ বেদুঈন জবাব দিলো, মোটেও না।
নবীজী তার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমি জানি তুমি দুর্ব্যবহারের জবাব
দুর্ব্যবহারের মাধ্যমে না দিয়ে ক্ষমার মাধ্যমে দিয়ে থাকো। লোকটির কথায় নবীজী হেসে ফেললেন এবং একটি উট বোঝাই করে যব, আরেকটি উট বোঝাই করে খেজুর দিয়ে দিলেন।
৩. একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে উমরের গৃহে গমন করলেন। নবীজির বসার জন্য আবদুল্লাহ একটি চামরার আসন পেতে দিলেন। কিন্তু রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওটার উপরে না বসে মাটিতে বসে পড়লেন। ফলে আসনটি আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যখানে পড়ে রইলো।
এ হলো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিনয়ের কয়েকটিমাত্র নজির। সৃষ্টির সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চে প্রশংসার অধিকারী হয়েই আল্লাহর রসূল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কেমন বিস্ময়কর বিনয়ের নমুনা দেখিয়ে গেলেন।
আমরা আজ এসব কথা প্রায় বিস্মিৃত হতে বসেছি। দারুণ অহংবোধ, অনর্থ আড়ম্বরের আয়োজন প্রায় সর্বত্র। আসুন বন্ধুরা, সীরাতে রসূলের আবেদনকে আমরা আমাদের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি। এবং আমলে মনোযোগ দিই। তবে আমরা তাঁর মহাব্বতের দাবিদার হতে পারবো।
সম্মান ও প্রশংসায় অতিরঞ্জনের প্রতি ঘৃণা
১. একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইরে কোথাও তাশরিফ নিয়ে গেলে উপস্থিত লোকজন তাঁর সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়নবী বিষয়টি পছন্দ করলেন না। তিনি ইরশাদ করলেন, ‘অনারবদের মতো সম্মান প্রদর্শনে দাঁড়িয়ে যাবে না।’৪
তিরমিযী শরীফের বর্ণনায় রয়েছে, হযরত আনাস রা. ইরশাদ করেন, ‘সাহাবায়ে কেরামের নিকট রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অধিক সম্মানিত কেউ ছিলো না। তদুপরি তাঁরা হযরতের অপছন্দের কারণে তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়াতেন না।’
আরেকবার নবীজী কোনো এক বিবাহ অনুষ্ঠানে তাশরিফ নিলেন। দুলার জন্য বিছানো চাদরে গিয়ে বসলেন। ঘরের ছোটো ছোটো মেয়েরা একত্র হয়ে দফ বাজিয়ে বদর যুদ্ধের শহীদানদের প্রতি নিবেদিত শোকগাথাগুলো আবৃত্তি করছিলো। এক পর্যায়ে তাদের একজন প্রিয়নবীর প্রশংসায় গেয়ে উঠলো, ‘ওয়া ফী-না নাবিয়্যুন ইয়া’লামু মা ফী গাদিন।’ অর্থাৎ, আমাদের মাঝে রয়েছেন এক নবী / আঁখির পলকে প্রতিভাত হয় যাঁর আগামী কালের ছবি। আল্লাহর নবী তখনই এ গান গাইতে বারণ করে বললেন, ‘এটা বাদ দাও; আগে যা গাইছিলে তাই গাও।’
২. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিশুপুত্র হযরত ইবরাহীম যেদিন ইন্তেকাল করেন কাকতালীয়ভাবে সেদিন সূর্যগ্রহণ হলো।
সবাই ভাবলো, নিশ্চয় এটা প্রিয়নবীর পুত্রের ইন্তোকলের ফলে ঘটেছে। শোকাহত আকাশ বুঝি এভাবে পালন করছে শোকÑ সবাই কাকতালীয় ঘটনাটিকে এভাবে নিলো।
ভাবুন তো, একজন যশাকাক্সক্ষী মানুষের জন্য এর চাইতে মহাসুযোগ আর কী হতে পারে! অতিমানবত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এর চেয়ে অনায়াস ব্যবস্থা আর কিইবা হতে পারে! এক্ষেত্রে শুধু মনোভাবই তো যথেষ্ট।
কিন্তু আল্লাহর রসূলের শান যে এর চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে! তিনি জনতাকে মসজিদে সমবেত করে স্পষ্ট ভাষণে জানিয়ে দিলেন, চন্দ্রগহণ ও সূর্যগ্রহণ আল্লাহর নিদর্শসমূহের দু’টি নিদর্শন। কারও জন্ম-মৃত্যুর কারণে এ দু’টির গ্রহণ ঘটে না।
সংক্ষিপ্ত কয়েকটি ঘটনায় আমরা আলোচ্য ক্ষেত্রে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেজাজ বুঝতে পারলাম। এই আত্মিক প্রশস্ততা ও স্বচ্ছতার বড়ো অভাব আমাদের মাঝে। প্রশংসাপ্রিয়তা, আত্মজ্ঞাপন প্রবণতা আমাদের মাঝে বড়ো প্রবল। এটা নিতান্ত খারাপ মনোভাব।
প্রশংসা ও সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন সম্মান ও প্রশংসাকারীর জন্য যেমন ঠিক নয়, তেমনি প্রশংসিত ও সম্মানপ্রদর্শিতের জন্যও তা কল্যাণকর নয়। এসবই অহংবোধের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়।
আমরা অনেকে আবার আত্মপ্রশংসায়ও মেতে উঠি যত্রতত্র। আত্মজ্ঞাপনের কোনো সুযোগই যেনো হাতছাড়া করতে চাই না। এসবই তো নবীজীর শিক্ষা ও মেজাজের পরিপন্থী। বন্ধুরা, আসুন আমরা পুনরায় আখলাকে নববীর আদর্শ নিয়ে একটু ভেবে দেখি, সেই মহান আদর্শকে বুকে ধারণ করে এসব মনোভাব ত্যাগ করি।
সততা
১. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার মদীনার অনতিদূরে তাঁবু ফেলা একটি কাফেলার পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। বণিকদের একটি উট নবীজীর খুব পছন্দ হলো। তিনি মালিকের নিকট উটটির মূল্য জিজ্ঞেস করেই উটের রশি ধরে বাড়ির পথে রওনা দিলেন। নবীজী চলে যাওয়ার পর হঠাৎ বণিকদের মাঝে চিন্তা এলোÑ একি! একজন অপরিচিত লোককে উট দিয়ে দিলাম সে যদি মূল্য নিয়ে আর ফিরে না আসে! এই ভেবে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ভর্ৎসনা করতে লাগলো। কাফেলার মাঝে এক বয়োবৃদ্ধা মহিলা ছিলো। সে তাদের আত্মভর্ৎসনা শুনে বলে উঠলো, ‘তোমরা এতাটা বিচলিত হলে কেনো? ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমি এমন দীপ্তিমান চেহারার অধিকারী মানুষ জীবনে কখনও দেখিনি। এ কোনো প্রতারকের চেহারা হতেই পারে না।’ এরপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটের মূল্য পাঠিয়ে দিলেন। সেই সাথে অতিরিক্ত দিলেন তাদের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী।
আরেক বারের ঘটনা। তিনি বিদেশি বণিকদের নিকট কতগুলো উট বিক্রি করলেন। তন্মধ্যে একটি উট ছিলো খুবই দুর্বল ও খোঁড়া। বণিকদল উট নিয়ে চলে গেলো। প্রিয়নবী ভাবলেন, তিনি তো বিক্রির সময় দুর্বল ও খোঁড়া উটটির কথা বণিকদেরতে বলে দেননি। তারা উটটির প্রতি খেয়াল করেনি বিধায় সুস্থ-সবল অন্যান্য উটের মূল্যে সেটিও কিনে নিলো। বিষয়টি তো বলে দেয়া দরকার ছিলো!
এরপর ঘোড়া ছুটিয়ে বণিকদের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন বিশ্বমানবতার সেরা আদর্শ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বণিক সরদার নবীজীকে দেখে অত্যন্ত বিস্মত কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ভাই আমরা তো আপনার মূল্য পরিশোধ করেই এসেছি, আপনি আবার কী জন্য এসেছেন?’ নবীজী তখন ব্যাপারটা খুলে বললেন। বণিকরা ভাবলো, লোকটা খুবই সহজ-সরল, নয়তো কেউ কি এভাবে ঠকতে চায়! তারা রসিকতা করে বলে উঠলো, ‘উট তো আমরা দেখে-শুনেই কিনেছি। খোঁড়া উট কিনে থাকলে সে তো আমাদেরই দোষ, এখন কি আর করা যাবে।’
নবীজী তাদেরকে বুঝাতে চাইলেন, খোঁড়া উটটির কথা তাদেরকে জানিয়ে দেয়া উচিত ছিলো, ভুলে তা বলে দেয়া হয়নি। ফাঁকিবাজির ব্যবসায় আল্লাহ নারাজ হবেন। এরপর তিনি অতিরিক্ত টাকা বণিকদেরকে ফেরত দিয়ে দিলেন।
নবীজীর এ আচরণ দেখে বণিকদের বিস্ময়ের অন্ত রইলো না। তারা অপূর্ব সততার শিক্ষা পেলো নবীজীর কাছ থেকে। এই ছিলো বিশ্বমানবতার আদর্শ হযরত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণিজ্যনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্যে অসৎ পন্থা অবলম্বন যেনো আমাদের সমাজে কোনো ব্যাপারই না। বিশেষত আমাদের শহুরে পরিবেশে এ ব্যাপারে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। ভালো যে কেউ নেই একেবারে তাই বলছি না। কিন্তু দু’চার জন যাঁরা এই প্রতিকূল ¯্রােতেও সৎ থাকতে চান তাঁরাও প্রতিকূল পরিবেশে বিপাকে পড়ে যান।
আজ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও আদর্শের ওপর অনড় থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে আমাদেরকে এবং নবীজীর সে সততার আহ্বান সমাজে বারবার প্রচার করতে হবে।
সাম্য
১. বদর যুদ্ধে যাত্রাকালে মুসলমানদের কাছে মাত্র কয়েকটি উট ছিলো। সিদ্ধান্ত হলো সাহাবায়ে কেরাম উটগুলো নিজেদের মাঝে ভাগাভাহি করে নেবেন। পালা বদল করে তাঁরা এগিয়ে যাবেন বদরের দিকে।
নিয়মানুযায়ী মহানবীর দলেও রয়েছেন দু’জন সাহাবী। তাঁরা ভাবলেন দু’জাহানের স¤্রাটও অন্যদের মতো পালা বদল করে উটে চড়বেন তা কী করে হয়! তারা নবীজীর খেদমতে এসে আবেদন করলেন, নবীজী পুরো পথ এককভাবে উটে চড়ে গেলে ভালো হয়। কিন্তু সেনাপতি রসূল তাতে রাজি হলেন না। সেনাপতি বলে তিনি আরাম করবেন আর সাধারণ সৈন্য বলে তারা পুরো পথ হেঁটে যাবেÑ এই বৈষম্য তিনি পছন্দ করলেন না। তিনি অন্যদের মতোই পালা বদল করে উটে চড়লেন।
এ ছিলো প্রিয়নবীর সাম্যনীতি। তাবৎ পৃথিবী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই শিক্ষা নিতে পারে এই নীতি থেকে। আজকের পৃথিবীতে ছোটো ও বড়োর যে বৈষম্য প্রায় সর্বত্র দেখা যায়, প্রিয়নবীর আদর্শের অনুসরণই কেবল তা দূর করতে পারে।
২. একবার হঠাৎ করে সংবাদ এসে পৌঁছলো যে, মুসলমানদের দুশমনেরা সম্মিলিতভাবে বিরাট রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে মদীনা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ শুনে সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মদীনার চতুর্দিকে পরিখা খনন করে শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দশজন দশজন দল করে দ্রুত কাজে নেমে পড়লেন। আল্লাহর নবী ঘুরে ঘুরে দেখলেন। এরপর বিলাল রা.-এর গ্রুপে এসে বললেনÑ ‘তোমাদের গ্রুপে যেহেতু নয় জন সুতরাং আমাকেও তোমাদের সঙ্গে নাও।’ সবাই কাজ করবে তিনি করবেন নাÑ এমনটি তাঁর পছন্দ নয়। তাই তাঁকে সাথে নিতেই হলো। এক পর্যায়ে বিলাল রা. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথায় এক টুকরি মাটি তুলে দিলেন। নবীজী বললেন, ‘আরেক টুকরি দাও।’ আরজ এলো, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, সবাই তো এক টুকরি করেই নিচ্ছে!’ আল্লাহর রসূল মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি তোমাদের মতো সাধারণ মানুষ হিসেবে এক টুকরি নিয়েছি, আরেক টুকরি নিতে হচ্ছে আমার নেতৃত্বের দায়িত্ব হিসেবে।’ অবশেষে প্রিয়নবীর পবিত্র মাথায় আরেক টুকরি মাটি তুলেই দিতে হলো।
এভাবে নেতা-কর্মীর মাঝে সমতা রক্ষা করে আদর্শ নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সাধারণত নেতৃত্বস্থানীয় লোকেরা সাধারণ কর্মীদের মতো কাজ করতে ইতস্তত বোধ করেন। মর্যাদা কমে যাবে ভাবেন। কিন্তু দোজাহানের বাদশা হযরত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ভাবেননি কখনও। তিনি নিজে কর্মীদের চেয়ে অধিক পরিশ্রম করে আদর্শ নেতৃত্বের শিক্ষা রেখে গেছেন। সেই নেতৃত্বের অনুসরণ আজও আমাদের মাঝে কল্যাণের প্রবাহ ঘটাতে সক্ষম।
সাদাসিধে জীবনযাপন
১. রহমাতুল্লিল আলামীনের বিছানা ছিলো খেজুর পাতার চাটাই। একদিন ঘুম থেকে জেগেছেন। কাছেই ছিলেন প্রিয় সাহাবী উমর রা.। তিনি চেয়ে দেখেন নবীজীর সারা পিঠে খেজুরপাতার দাগ পড়ে আছে। দোজাহানের স¤্রাট আখেরি নবী, সাইয়্যেদুল মুরসালীন এতো কষ্টে জীবনযাপন করবেন! প্রিয়নবীর জন্য একটু কোমল বিছানা তৈরির অনুমতি চাইলেন উমর রা. কিন্তু সাইয়্যেদুল মুরসালীন এই বলে বারণ করলেন যে, আল্লাহর নিকট ইহজীবনের কোনো মূল্য নেই। [পরকালের জীবনই হলো আসল জীবন।]
এ হলো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের সাদাসিধে জীবনযাপনের একটি দৃষ্টান্ত।
আজকের পৃথিবীতে আমাদের কাছে এসব কথা গল্পের মতোই মনে হবে। কারণ এ যুগের ক্ষমতাশীল ও তাঁদের পরিবারবর্গের পক্ষে এসব বিষয়ের কল্পনাও বোধ হয় কষ্টকর কামনা। আল্লাহ আমাদের সুমতি দান করুন।
জীবজন্তুর প্রতি দয়া
১. একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক আনসারীর বাগানে প্রবেশ করলেন। সেখানে একটি উট বাঁধা ছিলো। উটটির প্রতি নবীজীর চোখ পড়তেই উটটি ব্যাকুল হয়ে উঠলো এবং চোখেমুখে ওর এক করুণ অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটটির ব্যথায় ব্যথিত হয়ে ওর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। উটটি শান্ত হয়ে গেলো। নবীজী তখন আওয়াজ দিয়ে বললেন, এই উটটি কার? এক আনসারী যুবক এসে বললো, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, উটটি আমার।’ প্রিয়নবী তাকে বললেন, ‘এই বাকশক্তিহীন প্রাণীটির ব্যাপারে [আল্লাহ তোমাকে যার মালিক বানিয়েছেন] আল্লাহকে ভয় করো না? এই যে প্রাণীটি আমার কাছে অভিযোগ করেছে, তুমি তাকে অনাহারে রাখো এবং কঠিন কঠিন কাজ করিয়ে তাকে ক্লান্ত বানিয়ে দাও।’
২. আরেক দিনের ঘটনা। কোনো এক সফরে পথিমধ্যে কোথাও যাত্রাবিরতি করলেন। তারপর কোনো প্রয়োজনে অবস্থানস্থল হতে একটু দূরে গেলেন। এসে দেখেন এক সাহাবী এমন স্থানে চুলা জ্বালিয়েছেন যেখানে মাটির ভেতর পিপীলিকার গর্ত ছিলো। দেখে মহনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্ন করলেন, ‘কে করেছে এই কাজ?’ উক্ত সাহাবী আরজ করলেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি করেছি।’ নবীজী ইরশাদ করলেন, ‘চুলাটা নেভাও। এতে পিঁপড়াগুলোর কষ্ট হয়।’
এ হলো জীবজন্তুর প্রতি মহানবীর মমতার ছোট্ট দু’টি নজির। অনেকে মনে করেন যে, দয়ামায়া শুধু মানুষের জন্যই। জীবজন্তুর প্রতি আবার কিসের দয়া! এ ধারণা যে নিতান্তই দুঃখপ্রদ ও ভ্রম তা বলাই বাহুল্য।
আল্লাহর সকল মাখলুকের প্রতিই যে দয়াদ্র আচরণ করতে হবে আল্লাহর নবী আমাদেরকে তা শিখিয়ে দিলেন।
সওয়ারি ও মালবাহী জীবজন্তুর ব্যাপারে নির্দেশ হলোÑ এদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানো যাবে না, অনর্থক কষ্ট দেয়া যাবে না। গৃহপালিত পশুর ব্যাপারে নির্দেশ হলো, ঠিকমত তাদের পানাহার দিতে হবে। যেসব প্রাণী জবাই করে খাওয়া হয় তাদের ব্যাপারে নির্দেশ হলো যথাসম্ভব কম কষ্ট দিয়ে জবাই করতে হবে।
হযরত আব্বাস রা. বর্ণনা বরেন যে, একবার এক ব্যক্তি জবাই করার জন্য একটি প্রাণী শুইয়ে রেখে তাঁর ছুরিতে ধার দিচ্ছিলো। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দৃশ্য দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন। কাছে গিয়ে ইরশাদ করলেন, ‘তুমি কি প্রাণীটিকে দুইবার জবাই করতে চাও? ওকে শোয়ানোর পূর্বে ছুরি ধারিয়ে নিলে না কেনো?’
মানুষ বাকশক্তিহীন জীবজন্তুর প্রতি কী অত্যাচারই না চালিয়ে থাকে! সামান্য অপরাধেই জীবজন্তুকে নির্মমভাবে পেটায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবজন্তুর প্রতি কতো দয়াশীল ছিলেন উল্লিখিত ঘটনাগুলোর মাধ্যমে আমরা তা অনুমান করতে পারি। এসব জেনে শুধু জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করাই যথেষ্ট নয় বরং এসব থেকে বাস্তব শিক্ষা নিয়ে আমাদের জীবজন্তুর সাথে নরম আচরণ করতে হবে, অন্যথায় কেয়ামতের দিন অবশ্যই আমাদেরকে জবাবাদিহি করতে হবে।
শিশুদের প্রতি ¯েœহ-মমতা
১. একবার সাহাবী খালিদ ইবনে সাঈদ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন। সাথে তাঁর ছোট্ট মেয়েটি। লাল জামা পরিহিতা মেয়টিকে বাহবা দিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ছানাহ! ছানাহ!’ মানে সুন্দর সুন্দর। হাবশী ভাষায় ছানাহ মানে সুন্দর। মেয়েটির জন্ম হাবশায় [আফ্রিকা] হয়েছিলো। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সামঞ্জস্যে তাকে হাবশী ভাষায় সুন্দর সুন্দর বলে আনন্দ পেলেন।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে ছোট্ট মেয়েটি প্রিয়নবীর পৃষ্ঠদেশে শোভমান কবুতরের ডিম্বসদৃশ মহরে নবুওয়ত দেখতে পেলো। শিশুরা কৌতূহলী হয়ে থাকে। অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলে তা নিয়ে খেলা শুরু করে। এ মেয়েটিও তাই করলো। সে নবীজীর প্রবিত্র মুহরে নবুওয়ত নিয়ে খেলতে শুরু করলো। খালিদ রা. তাকে ধমক দিলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ধমকাতে বারণ করে বললেন, ‘আহা, ওকে খেলতে দাও।’
২. একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ আদরের দৌহিত্র হুসাইন রা. লাল জামা পরিধান করে ধীরে ধীরে তাঁর কাছে চলে এলো। নিতান্তই অল্পবয়সী হওয়ার কারণে কাঁপাকাঁপা পায়ে হাঁটছিলো সে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদরের আতিশয্যে মিম্বর থেকে নেমে এলেন। আদরের হুসাইনকে কোলে তুলে নিয়ে ইরশাদ করলেন, ‘আল্লাহ ঠিকই বলেছেন, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ।’
আরেক দিন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসান ইবনে আলী রা.-কে ডাকলেন। হাসান দৌড়ে এসে কোলে চড়ে বসলো। এরপর প্রিয় নানার দাড়ি মুবারকে অঙ্গলি ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে খেলা করতে লাগলো। মহানবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পর্যায়ে তাঁর পবিত্র মুখ খুলে দিলেন। হাসান পরমানন্দে এবার মুখের ভেতরে অঙ্গুলি ঢুকিয়ে খেলা করতে লাগলো।
উল্লেখ্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর-¯েœহ শুধু মুসলমান শিশুদের জন্য ছিলো না। তিনি বিধর্মী শিশুদের প্রতিও ¯েœহশীল ছিলেন। তিনি বলতেন যে, প্রত্যেক শিশুই আল্লাহর স্বভাবধর্মের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তারপর পিতামাতা তাকে ইহুদি নাসারা ও অগ্নিপূজক বানায়।
জীবনের প্রতিটি অঙ্গনেই আমরা খুঁজে পাই প্রিয়নবীর মানবিকতার অতুলনীয় আদর্শ। যে আদর্শে আমাদের ইহকাল ও পরকালের শান্তি ও সাফল্য নিহিত। প্রিয় পাঠক, তাই আসুন আমরা আন্তরিক আগ্রহে প্রিয়নবীর পবিত্র সীরাত পাঠ করি এবং আমাদের প্রতিদিনের জীবনে তা প্রতিফলিত করি।
তত্বসূত্র :
১  বুখারী শরীফ, ১ম খ., পৃষ্ঠা-৫৫৪
২  আখলাতে নবী ওয়াকেয়াতকে আয়নাহ মে, মাওলানা হিফযুর রহমান কাশেমী রহ.
৩  আখলাকে নববী, পৃষ্ঠা-১২৩
৪  সীরাতুন নবী, আল্লামা শিবলী নোমানী রহ.।
৫. আবু দাউদ, কিতাবুল আদব।
৬. মিশকাত শরীফ।

No comments:

Post a Comment