যাকাতের উদ্দেশ্য এবং দাতা ও গ্রহীতার জীবনে তার প্রভাব : মুফতি তাকি ওসমানী

যাকাত ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম একটি ভিত্তি। যাকাত ওয়াজিব করার দ্বারা
ইসলামের লক্ষ্য শুধু ধন-সম্পদ সংগ্রহ করা এবং রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ
করাই নয়। অভাবী ও দুঃখী মানুষের শুধু অভাব ও দুঃখ দুর্দশা দূর করা উদ্দেশ্য
নয়; বরং তার প্রথম লক্ষ্য দাতার জীবনে বিস্তর কার্যকরি প্রভাব ফেলা, তাকে
বস্তুগত চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠানো, তার ভিতরকার মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন
সাধন করা, ইত্যাকার নানাবিধ উপকারিতা ও প্রভাব রয়েছে যা দাতার জীবনে
পরিলক্ষিত হয়। আমরা তা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
১. যাকাত অন্তরকে লোভের কলুষতা হতে পবিত্র করে একজন কালেমাধারী মুসলমান
যখন বৈষয়িক চিন্তার ঊর্ধ্বে ওঠে শুধু আল্লাহর হুকুম পালন ও তার সন্তুষ্টি
অর্জনের নিমিত্তে যাকাত দেয়, সে যাকাত তাকে পাপাচারের পঙ্কিলতা, গোনাহের
কলুষতা এবং বিশেষভাবে লোভ ও কার্পণ্যের হীনতা, নীচতা ও সঙ্কীর্ণতা হতে
পবিত্র করে, মুক্তি দেয়। কেননা, মানুষের মধ্যে রয়েছে আত্মপ্রেম এবং
ধন-সম্পদের মালিক হওয়া, লিপ্সা, স্পৃহা ও দুনিয়ায় স্থিতি লাভের প্রেরণা।
এসব প্রকৃতিগত ভাবধারার লক্ষ্য ও প্রকাশক হচ্ছে ব্যক্তির লোভ ও কার্পণ্য।
তাইতো মানুষের মাঝে রয়েছে অন্য মানুষের তুলনায় নিজেকে বেশি বেশি কল্যাণ,
মুনাফা ও সুবিধার দৌলতে সমৃদ্ধ করে তোলার কামনা ও বাসনা। স্বয়ং আল্লাহ
তাআলা বলেছেনÑقُل لَّوْ أَنتُمْ تَمْلِكُونَ خَزَائِنَ رَحْمَةِ رَبِّي إِذًا لَّأَمْسَكْتُمْ خَشْيَةَ الْإِنفَاقِ وَكَانَ الْإِنسَانُ قَتُورًا
‘বলুন যদি আমার পালনকর্তার রহমতের ভাণ্ডার তোমাদের হাতে থাকত, তবে ব্যয়িত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অবশ্যই তা ধরে রাখতে। মানুষ তো অতিশয় কৃপণ।’ [সূরা বনি ইসরাইল : ১০০]
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘মনকে কার্পণ্য ও লোভ পরিব্যাপ্ত করে নিয়েছে।’ [নিসা : ১২৮]
আর এ লোভ ও কার্পণ্য একটা কঠিনতর বিপদ, ব্যক্তির জন্যও যেমন- সমাজের জন্যও তেমন। লোভ ও কার্পণ্য মানুষকে রক্তপাতের দিকে তাড়িত করে, দীন-ধর্ম লঙ্ঘন করতে ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে শত্র“র হাতে বিক্রি করে দিতেও প্ররোচিত করে। এমনকি নিজের মান-মর্যাদা, ইজ্জত-আব্র“ ভূলুণ্ঠিত হওয়ার কারণ ঘটায়।
তাই যারা লোভ ও কার্পণ্য থেকে বেঁচে থাকতে পারবে তারা সফল ও কৃতকার্য। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ
وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘যারাই তাদের মনের লোভ ও কার্পণ্যকে রোধ করতে সক্ষম হবে, তারাই কল্যাণধন্য ও সফলকাম হবে। [হাশর : ৯, তাগাবুন : ১৬]
মনের সে লোভ ও কার্পণ্য হতে যাকাত মানুষকে পরিত্রাণ ও মুক্তি দেয়। সে মুক্তি মালের বন্ধনের জিল্লতি হতে, মনের কাতরতা ও অধঃগতি থেকে, টাকা-পয়সার দাসত্বের হীনতা ও নীচতা থেকে।
কেননা, ইসলাম চায় একজন মুসলমান সবকিছুর অধীনতা-আনুগত্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে কেবল আল্লাহর বান্দা হোক। এ বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছেÑ বস্তুগত উপাদান, উপকরণ ও দ্রব্যসামগ্রীÑ মানুষ সে সবকিছুর কর্তা ও নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়াক। আল্লাহ মানুষকে দুনিয়াতে তাঁর প্রতিনিধি ও সৃষ্টির সেরা বানিয়েছেন, কিন্তু সে শুরু করে দিয়েছে নফসের দাসত্ব, বস্তু ও সম্পদের উপাসনা-এর চাইতে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে? আর যাকাত সেই অন্তরকে লোভ-লালসার কলুষতা থেকে মুক্তি দেয়।
২. যাকাত দানশীলতার অভ্যাস গড়ে তোলে।
যাকাত যেমনি মুসলমানের অন্তরকে লোভের কলুষতা থেকে পবিত্র করে, তেমনি তা দানশীলতা, খরচ করা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকারের অভ্যাস গড়ে তোলে। একথা সর্বজনবিধিত যে, অভ্যাসের বিরাট প্রভাব রয়েছে মানুষের চরিত্রে, আচার-আচরণে ও তার লক্ষ্য নির্ধারণে। একারণেই বলা হয়ে থাকে ‘মানুষ অভ্যাসের দাস এবং অভ্যাস দ্বিতীয় প্রকৃতি’ অর্থাৎ মানুষের মাঝে অভ্যাসের একটা শক্তিশালী ও কার্যকরী আধিপত্য রয়েছে, যা মানুষের সৃষ্টিগত প্রকৃতির অনুরূপ দৃঢ় হয়ে থাকে।
যে মুসলমান ফসল কাটার সাথে সাথেই তার যাকাত, ওশর বা খারাজ দিয়ে দেয়, তার গবাদি পশু; ব্যবসায়িক পণ্য ও অন্যান্য আয়ে বছর পূর্ণ হতেই যাকাত দিতে অভ্যস্ত হয়, ঈদুল ফিতরের নামাযের পূর্বেই ফিতরা দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করে, এ মুসলমান দানশীলতা ও অর্থব্যয়ের মৌলিক গুণের অধিকারী হয়ে যায়। তার এ চরিত্র প্রকৃতির গভীরে শিকড় গেড়ে মজবুত অবস্থান নেয় এবং এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে।
এ কারণে এ চরিত্রটি কুরআনের দৃষ্টিতে মুত্তাকি, পরহেযগার-মুমিনের অন্যতম গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যখন মহাগ্রন্থ আল কুরআন খুলে বসে ও প্রথম সূরা আল-ফাতিহা পাঠের পর পরবর্তী পৃষ্ঠার দিকে তাকায় সূরা আল-বাকারা পাঠের উদ্দেশে, সেখানে মুত্তাকিদের গুণাবলি চোখে পড়ে। ইরশাদ হচ্ছেÑ
الم [٢:١]ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ [٢:٢]الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ [٢:٣]
‘আলিফ-লাম-মিম, এ সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা মুত্তাকিদের জন্যে হেদায়াত। (মুত্তাকি) তারা, যারা গায়বের প্রতি ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ [সূরা বাকারাহ-১-৩]
এছাড়াও পবিত্র কুরআনের সূরা আশ-শুরা আয়াত ৩৬, ৩৭। সূরা বাকারা আয়াত-৩২৭, আলে ইমরান আয়াত-১৭, ১৩৪। আয যারিয়াত আয়াত- ৩১৫, ১৯, মাআরিয আয়াত-১৯-২৪, সূরা আল লায়ল আয়াত-১-২১, এসব আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতে এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছে। এ বিষয়ে তাফসীরের কিতাবসমূহে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। উৎসুক পাঠক তা থেকে উপকৃত হতে পারেন।
৩. যাকাতদাতা আল্লাহর চরিত্রে ভূষিত হয়
মানুষ যদি কার্পণ্য ও লোভ থেকে পবিত্র হতে পারে, দান-ব্যয় ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত হতে পারে, তাহলেই সে মানবীয় লোভের পঙ্কিলতা থেকে ঊর্ধ্বে ওঠতে পারে, আল্লাহপ্রদত্ত উচ্চতর পূর্ণাঙ্গ গুণাবলিতে ভূষিত হতে পারে। কেননা, মহান আল্লাহ তাআলার অসীম গুণাবলির অন্যতম হচ্ছেÑ কল্যাণ, রহমত, অনুগ্রহ ও দয়াবর্ষণ। এ গুণাবলি অর্জনের উদ্দেশে মানবীয় শক্তি সামর্থ্যানুযায়ী চেষ্টা করে আল্লাহর চরিত্রে ভূষিত হওয়া একান্ত আবশ্যক। আর তাই হচ্ছে মানুষের উন্নতি ও উৎকর্ষের চরমতম মান।
ইমাম আল রাযি বলেন, মানুষ যে ‘নফসে নাতেকার’ দরুন মানুষ হয়েছে, তার দু’টি শক্তি: ১.আকিদা বা বিশ্বাসগত এবং ২.আমলি বা বাস্তব কর্মগত। বিশ্বাসগত শক্তির পূর্ণত্ব নিহিত রয়েছে আল্লাহর আইন-কানুনের বড়ত্ব স্বীকার ও তাঁর প্রতি মর্যাদা দানে। আর বাস্তবÑকর্মগত শক্তির পূর্ণত্ব নিহিত রয়েছে আল্লাহর সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য করাতে। একারণে আল্লাহ তাআলা যাকাত ফরজ করেছেন, যাতে আত্মার মৌলশক্তি এই পূর্ণত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। এই তত্ত্বকে সামনে রেখেই তাফসীর কবীরে উল্লেখ হয়েছে Ñ‘তোমরা সকলে আল্লাহর চরিত্রে ভূষিত হও।’ [তাফসিরে কাবির : ১০১/১৬]
উল্লেখিত কথাটি কোন হাদীস নয়, তবে হুযূর সা. এর একটি হাদীসের ভাবার্থ যা রাসূলের আখলাক নিয়ে হযরত আয়েশা রা. কে প্রশ্ন করায় তিনি বলেছিলেন, রাসূলের চরিত্র হলো আল কুরআন। যেহেতু পবিত্র কুরআন আল্লাহর কালাম। আর আল্লাহর কালাম আল্লাহরই অংশ। তাই রাসূলেরমত তোমরাও আল্লাহর চরিত্রে অর্থাৎ কুরআনে বর্ণিত চরিত্রে ভূষিত হও।
৪. যাকাত প্রদান খোদাপ্রদত্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
সুন্দরকে সুন্দর বলা এবং নেয়ামতের শোকর- কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা একান্ত অপরিহার্য। এটা বিবেক ও নৈতিকতার দাবি এবং সকল ধর্ম ও আইন একথার সমর্থন যোগায়।
‘যাকাত’ স্বীয় দাতার মন-মানসিকতায় আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার ভাবধারা জাগিয়ে তুলে। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালি রহ. লিখেনÑ ‘আল্লাহর অফুরন্ত ও অজস্র নেয়ামত রয়েছে তাঁর বান্দাদের মনে ও ধনে। দৈহিক ইবাদতসমূহ দৈহিক নেয়ামতের শোকর আর আর্থিক ইবাদতসমূহ আর্থিক নেয়ামতসমূহের শোকর। [ইহ্ইয়াও উলমুিদ্দনÑ ১৯৩/১]
বস্তুত, যাকাত হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামতের বিনিময়। প্রতিটি নেয়ামতের বিনিময়ে মানুষকে যাকাত দেওয়া একান্ত আবশ্যক। সে নেয়ামত বস্তুগত হোক বা তাৎপর্যগত। একারণে বলা হয়ে থাকে; ‘তুমি তোমার সুস্থতার যাকাত দাও, তোমার দৃষ্টিশক্তির যাকাত দাও, তোমার জ্ঞানের যাকাত দাও, তোমার সন্তানের যাকাত দাও’Ñ এ ভাবধারা মুসলমানের অন্তরে জেগে ওঠা প্রয়োজন। হাদীসেও বলা হয়েছেÑ প্রত্যেকটি জিনিসেরই যাকাত রয়েছে। আর শরীরের যাকাত হচ্ছে রোযা।
৫. যাকাত দুনিয়াপ্রেমের চিকিৎসা
আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য মাল উপার্জন ও সঞ্চয় করাকে মুবাহÑ জায়েয করে দিয়েছেন। দুনিয়ার যাবতীয় পাক-পরিচ্ছন্ন ও হালাল জিনিসই তার জন্য জায়েয। কিন্তু একেই জীবনের একমাত্র চিন্তাÑধারার বিষয় ও চরম লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করতে আল্লাহ কখনো রাজি নন। কেননা, মানুষ তো এর চেয়েও অনেক উঁচু ও মহান উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্ট হয়েছে। তার জন্য নির্মিত হয়েছে চিরন্তন উদ্যান। এ বিশ্ব চরাচর মানুষের জন্যই সৃষ্ট। আর সে নিজে সৃষ্ট পরকাল তথা আল্লাহর ইবাদতের জন্য। এ দুনিয়াটা তো পরকালের পথ। মানুষ এ পথকে সুন্দর সুসজ্জিত করে গড়ে তুলুক তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু হয়েছে উল্টো। মানুষ দুনিয়াতে এসে দুনিয়ার মায়াজালে আটকে পড়েছে, দুনিয়াপ্রেমে বিভোর হয়ে গেছে। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেনÑ
‘মানবকুলকে মোহগ্রস্ত করছে নারী, সন্তান-সন্তুতি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়। [সুরা আলে ইমরান : ১৩]
হাদীসে এসেছে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
‘দুনিয়ার ভালোবাসা সব অনিষ্টের মূল।’
মানুষ যখন দুনিয়ার পেছনে পড়ে যায়, দু’হাতে মাল কামাতে থাকে, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে বলতে চান : থাম! যা অর্জন করেছ, তা থেকে ব্যয় কর; দান করÑ এর মধ্যে আল্লাহর হক রয়েছে, তা বের কর। ফকীরের হক রয়েছে, তা পৃথক করে দাও। তখন দুনিয়াপ্রেমে বিভোর ব্যক্তির ঘোর কেটে যায়। দুনিয়ার মহব্বত দূরীভূত হতে থাকে। অতএব বলা যায়, যাকাত ফরজ করা হয়েছেÑ দিল থেকে দুনিয়া ও ধন-সম্পদের প্রেমরোগের সুনির্দিষ্ট ও সঠিক চিকিৎসা বিধানের লক্ষ্যে।
৬. যাকাত ধনীর ব্যক্তিত্ব বিকাশ করে
‘যাকাত’ ধনীর ব্যক্তিত্বের সমৃদ্ধি ও তার অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ সাধন করে। তাই যে ব্যক্তি কল্যাণের হাত প্রসারিত করে দান-খয়রাত করে, যাকাত দেয়, তার মধ্যে একটা প্রশান্তি, সম্প্রসারতা এবং তার বক্ষে উদারতা ও বিশালতা অনুভব করতে শুরু করে। যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার সুখ পায়। ওপরন্তু সে তার লালসা ও লোভের শয়তানকে দমন করতে সক্ষম হয়।
এটাই হচ্ছে মানসিক ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন তথা আত্মিক ঐশ্বর্য লাভ। কুরআনের এই আয়াতের মধ্যে
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا
তাদের মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। [সূরা তাওবা : ১০৩]
‘তাতহির’ ও ‘তাযকিয়া’ শব্দদ্বয় থেকে আমরা আত্মিক ঐশ্বর্য লাভ এ তাৎপর্য অনুধাবন করেছি। কেননা, আয়াতে ‘তাতহির’ ও ‘তাযকিয়া’ শব্দদ্বয় ‘এবং’ বলে আনা হয়েছে। যা থেকে উপর্যুক্ত তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠে।৭. যাকাত ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে
যাকাত ধনী এবং তার সমাজের মধ্যে গভীর ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করে, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি, সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব উদ্ভাবন করে, যা অত্যন্ত দৃঢ় ও দুñেদ্য হয়। কেননা, মানুষ যখন অন্য কারো সম্পর্কে জানতে পারে যে, সে তার জন্য যা ক্ষতিকর তা দূর করতে চায়, তাহলে সে তাকে ভালোবাসবে স্বাভাবিকভাবেই, তার মন-মানস তার প্রতি আকৃষ্ট হবে অনিবার্যভাবে। এজন্য হাদীসে বলা হয়েছে Ñ ‘যে লোক যার কল্যাণ করল, তার দিলে তার প্রতি স্বভাবতই ভালোবাসা জাগবে। আর যে তার অকল্যাণ করেছে, তার প্রতি স্বভাবতই জাগবে অসন্তোষ ও ক্রোধ।’
ফকির-মিসকিনরাও যখন জানবে যে, এ ধনী ব্যক্তি তার ধন-মালের একটা অংশ তাকে দিবে, তখন তারা তার জন্য আল্লাহর কাছে দোআ করে। সে সব দোআ, আন্তরিক শুভেচ্ছা সে ব্যক্তির সর্বক্ষণ কল্যাণকর ও মহানুভবতার কাজে নিমগ্ন থাকার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
৮. যাকাত সম্পদের পবিত্রতা সাধন করে
‘যাকাত’ যেমনি অন্তরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে. তেমনি তা ধনী ব্যক্তির ধন-মালের পবিত্রতা সাধন করে, প্রবৃদ্ধি ঘটায়।যাকাত মালকে পবিত্র করে এভাবে যে, মালের সাথে অপর লোকের মাল মিলেমিশে থাকলে তা কলুষিত হয়। অপরের মাল বের করে না দেওয়া পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারে না। এদিকে লক্ষ্য রেখেই পূর্বকালের কেউ বলেছেনÑ ‘অপহৃত ইট কোনো দালানে থাকলে তার ধ্বংস তাতেই রয়েছে।’ অনুরূপভাবে ফকির-মিসকিনের যে পয়সা ধনীর মালের সাথে মিশে রয়েছে, তার সবটুকুই তাতে কলুষিত হয়ে গেছে। এ কারণেই নবী কারীম সা. বলেছেনÑ ‘তুমি যখন তোমার মালের যাকাত দিয়ে দিলে, তখন তুমি তা থেকে খারাবিটা দূর করে দিলে।’
৯. যাকাত দিলে মাল কমে না, বাড়ে
যাকাত দেওয়ার দ্বারা মালের মধ্যে বরকত হয়। মাল বাড়ে, কমে না। কেননা, যাকাতবাবদ প্রদেয় এ সামান্য অংশ তার কাছে কয়েকগুণ বেশি হয়ে ফিরে আসে। এটা কখনও সে জানতে পারে, আবার কখনো জানতে পারে না। দেখুন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ
قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ وَمَا أَنفَقْتُم مِّن شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
‘বলুন! আমার পালনকর্তা তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা রিযিক বাড়িয়ে দেন এবং সীমিত পরিমাণে দেন। তোমরা কিছু ব্যয় কর, তিনি তার স্থলাভিষিক্ত বানান। তিনি উত্তম রিযিকদাতা। [সূরা সাবা : ৩৯]
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছেÑ
‘শয়তান তোমাদেরকে অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ হতে ক্ষমা ও বেশি অনুগ্রহের প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ।’ [বাকারা : ২৬৮]
সূরা রুমে দেখুন Ñ
وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ
‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তোমরা যে যাকাত দাও; তারা দ্বিগুণ লাভ করে।’ [সূরা রুম : ৩৯]
অপর স্থানে আল্লাহ তাআলা বলেন Ñ
‘আল্লাহ তাআলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন, এবং দান-খয়রাতকে বর্ধিত করেন।’ [সূরা বাকারা : ২৭৬]
এসব আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, আল্লাহর রাস্তায় যা দেওয়া হয় তার কয়েক গুণ প্রদান করাই আল্লাহ তাআলার রীতি। এর অন্যথা হতে পারে না।
১০. যাকাত তার গ্রহণকারীকে অভাবগ্রস্ততা থেকে মুক্তি দেয়
যাকাত তার গ্রহণকারীকে অভাবগ্রস্ততা থেকে মুক্তি দেয়। ইসলাম চায় মানুষ অতীব উত্তম ও পবিত্র জীবন-যাপন করুক। উপর থেকে অবতীর্ণ নেয়ামতসমূহ এবং নিচ থেকে প্রাপ্ত সম্পদসমূহ আয়ত্ত করে তারা ধন্য হোক। যাতে পরম শান্তি ও সমৃদ্ধিতে তাদের দিন কানায় কানায় ভরে যাবে, আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতায় তাদের মন ও জীবন ভরপুর হয়ে উঠবে।
দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় জর্জরিত হোক কোনো মানুষ, তা ইসলামের কাম্য নয়। কিন্তু সে দারিদ্র্য যদি বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটি ও সামষ্টিক জুলুম, নিপীড়ন ও বঞ্চনার দরুন হয়, তাহলে দারিদ্র্যের সাথে ইসলামের শত্র“তা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ তীব্রতর হয়ে উঠে।
এ কারণেই আল্লাহ তাআলা যাকাত ফরজ করেছেন। যা ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের মাঝে তা বিতরণ করা হবে। তা পেয়ে অভাবী মানুষ তাদের প্রয়োজন ও অভাব-অনটন দূর করবে, খাবার, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিবে। এর মাধ্যমে তারা আনুগত্য ও অনুসরণে লিপ্ত হবে।
বিত্তশালী মানুষদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, স্বীয় যাকাত দিয়ে ফকির-মিসকিনদের কোনোরূপ অপমান-লাঞ্ছনা দেওয়া, তাদের অনুভূতিতে আঘাত হানা, তাদের ওপর অনুগ্রহ প্রদর্শন করা থেকে।
আল্লাহ তাআলা বলেছেনÑ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُم بِالْمَنِّ وَالْأَذَىٰ كَالَّذِي يُنفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাতকে নষ্ট করো না, সে ব্যক্তির মতো যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মতো যার ওপর কিছু মাটি পড়েছিল। তারপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল।’ [বাকারা : ২৬৪]
১১. যাকাত হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে
যাকাত হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে দাতা ও গ্রহীতা উভয়কে রক্ষা করে। দারিদ্র্যের যাতাকলে পিষ্ট ও অভাবের যাতনায় ক্লিষ্ট অভাবী মানুষ যখন নিজের চতুর্দিকের মানুষকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতে দেখে, তখন এ ব্যক্তির অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষের বিষবাষ্প জন্মাবে। তার দিলে পরশ্রীকাতরতা জাগবে। তার অন্তরে বিত্তশালীদের প্রতি চরম ঘৃণা সৃষ্টি হবে। কেননা, একজন বাস করছে পাঁচ তলায়, অন্যজন গাছতলায়।
ইসলাম গরীব-ধনীর ভেদাভেদকে হ্রাস করতে চায়। পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের স্থায়ী বন্ধন গড়ে তুলতে চায়। তাই হাদীসে এসেছেÑ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই।’ [বুখারি, মুসলিম]
কিন্তু এক ভাই যদি পেট ভরে খায় আর অন্য ভাই অভুক্তের জ্বালায় ছটফট করতে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে কাক্সিক্ষত ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ও স্থায়ী হতে পারে না কখনো।
সেই ভ্রাতৃত্বকে কায়েম এবং গরীব-দুঃখীর হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত করার জন্য ইসলাম যাকাত ফরজ করেছে। যেন বেকারের কর্মসংস্থান হয়, অক্ষম-উপার্জনহীন মানুষও বাঁচার নিরাপত্তা পায়, ঋণগ্রস্তের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা হয়, পথহারা নিঃস্ব পথিক আপন ঘরে ফিরে যেতে পারে। তখনই মানুষ প্রকৃত অর্থে অনুভব করতে পারবে- তারা পরস্পরে ভাই, একে অপরের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক। প্রয়োজন ও অভাবের সময় বিত্তশালীদের মাল গরীবদের কাজে লাগে।
বস্তুত এমন পবিত্র পরিবেশেই ঈমানের ছায়া বিস্তার হওয়া সম্ভব। লোকদের মাঝে জাগতে পারে ভ্রাতৃত্ববোধ, ভালোবাসা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা।
রাসূলে কারীম সা. বলেনÑ
‘তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিযী)
অনুবাদক : মুহাদ্দিস, প্রাবন্ধিক।
No comments:
Post a Comment