Wednesday, July 9, 2014

অর্থ না বুঝে কুরআন পড়া কি অনর্থক?

অর্থ না বুঝে কুরআন পড়া কি অনর্থক? 

- শাহ জালাল মুহাম্মদ

quran
কুরআনুল কারীম আল্লাহ তাআলার সর্বশ্রেষ্ঠ কালাম তথা সর্বোত্তম কথামালা ও বাণী চিরন্তন। যারা কুরআন পাঠ করে তারা স্বয়ং মহান আল্লাহর সাথে কথোপকথন করে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন- ‘তোমাদের কেউ তার প্রতিপালকের সাথে কথা বলতে চাইলে সে যেন কুরআন পড়ে।’ [আল বুরহান ফী তাজবীদীল কুরআন : ৩]
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো আমরা নিজেদেরকে আল্লাহপ্রেমিক দাবী করলেও অন্তরে আল্লাহর সাথে কথা বলতে অনীহা পেশ করি। প্রকৃত প্রেম ও ভালোবাসা তো তাকেই বলে যাতে প্রেমিক বিভিন্ন বাহানায় প্রেমাষ্পদের সাথে কথা বলার জন্য উপলক্ষ্য অন্বেষণ করতে থাকে।
হযরত মুসা আ.-কে আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করলেন, وَمَا تِلْكَ بِيَمِينِكَ يَا مُوسَىٰ “মুসা! তোমার হাতে কি?” উত্তরে কেবল লাঠি বলাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তিনি তো আল্লাহর নবী, আল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক। তাই প্রিয়তমের সাথে কথা বলার সুবর্ণ সুযোগ লুফে নিয়ে লম্বা চওড়া উত্তর দিলেন- قَالَ هِيَ عَصَايَ أَتَوَكَّأُ عَلَيْهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَىٰ غَنَمِي وَلِيَ فِيهَا مَآرِبُ أُخْرَىٰ “তিনি বলেন- এটা আমার লাঠি, আমি এর ওপর ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার মেষের জন্য বৃক্ষপত্র ঝেড়ে ফেলি এবং এতে আমার জন্য কাজও চলে।” [সূরা ত্বাহা : ১৮]
তিনি প্রশ্নের জবাবের ওপর আরও তিনটি বিষয় বাড়িয়ে বলেছেন শুধুই প্রেমাষ্পদের ইশক ও মুহাব্বতের আতিশায্যে।
সারকথা হলো, প্রেমিক প্রেমাষ্পদের সাথে আলাপচারিতায় অকল্পনীয় স্বাদ উপপভোগ করে থাকে। অথচ এই মহামূল্যবান সুযোগ মুসলমানগণ ঘরে বসেই লাভ করতে পারে। যখনই ইচ্ছে হবে তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে কথোপকথনের সৌভাগ্য অর্জন করে নিবে। রাসূল সা. বলেন, “কুরআন শরীফ তিলাওয়াত সর্বোত্তম ইবাদত।” [কানযুল উম্মাল : ২২৬৩]
হাদীসের ভাষ্যে বুঝা যায় নফল ইবাদত হিসেবে সর্বোত্তম হলো কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত। প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য কুরআন শিক্ষা করা এবং তিলাওয়াত করা।
মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাও. আবরারুল হক হারদুঈ রহ. যিনি হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ. এর সর্বশেষ খলীফা। তিনি বলেন, ‘কুরআনের প্রতি পৃষ্ঠা তিলাওয়াতে কম করে হলেও পাঁচ হাজার নেকী লাভ হয়।’সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ আছে। যারা বলে ‘অর্থ না বুঝে কুরআন পড়া অনর্থক।’ নিজেরা তো কুরআন পড়েই না অন্যদেরও বেহুদা ও অযৌক্তিক যুক্তি দেখিয়ে কুরআন পড়তে নিষেধ করে। এতে শুধু নিজেরাই ধ্বংস হচ্ছে না সাধারণ মুসলমানদেরকেও জাহান্নামি বানাচ্ছে। কেননা নামায সহীহ হওয়া নির্ভর করে কুরআন সহীহ করে তিলাওয়াত করার ওপর। আর কুরআন বিহীন নামায কাউকে জান্নাতমুখী করতে পারে না।
হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ. এর নিকট এক ব্যক্তি এমন একটি প্রশ্ন নিয়ে এলে তিনি খুব চমৎকারভাবে প্রশ্নের জবাব দেন। প্রশ্নটি ছিলো- “আমরা কুরআন বুঝি না এমতাবস্থায় না বুঝে পড়ে কী লাভ? অথবা বাচ্চাদেরকে তোতা পাখীর ন্যায় কুরআন পড়িয়ে কী ফায়দা? এরা তো অর্থ বুঝে না।” তখন হযরত থানভী রহ. কয়েকটি জবাব দেন। তিনি বলেন-
১. অর্থ বোধগম্য না হলে কেবল শাব্দিক পাছে লাভ নেই এই যুক্তিই তাদেরকে সংশয়ে ফেলে দিয়েছে। তাই এই অসার যুক্তির কারণে তিলাওয়াত ত্যাগ করে বসে আছে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তির দাবিতে কেবল শব্দ নয় অর্থের জ্ঞানও অর্জন করা আবশ্যক। কিন্তু তারা শুধু অর্থের গুরুত্বারোপ করতে যেয়ে তিলাওয়াতের গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছে। তাদের অনুধাবন করা উচিত অর্থ বুঝা শব্দ পাঠের অনুগামী। প্রথম বিষয় হলো শব্দের জ্ঞান। আর নীতি হলো, প্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রারম্ভিকও প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে। তাই “শাব্দিক তিলাওয়াত লাভহীন” এই ধারণা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তারা অর্থ বুঝে না বিধায় তাদের সন্তানদেরকে শৈশবে তিলাওয়াত না শিখিয়ে বড় হওয়ার পর তিলাওয়াত শিখাতে দেখলে তাদের ব্যাখ্যা মেনে নিতাম। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো অবস্থাতেই সন্তানদেরকে তিলাওয়াতের দীক্ষা দিচ্ছে না। এতে প্রতীয়মান হয় যে, তারা শাব্দিক তিলাওয়াতকে নি®প্রয়োজন মনে করছে এবং নি®প্রয়োজন প্রমাণ করার কোশেশও করছে।
২. প্রকৃতপক্ষে এ প্রশ্নটি কুরআন পাঠ থেকে দুরত্ব সৃষ্টির একটি অপকৌশলমাত্র। কেননা এরা তো বাহ্যতঃ মুসলমান। এজন্য তারা কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি অনীহা প্রকাশ করতে পারছে না। তারা একথা ভালভাবেই জানে, তিলাওয়াতকে গুরুত্বহীন বলা মাত্রই তাদের বিরূদ্ধে কুফর এর ফতোয়া আসতে পারে। তাই একটা মনগড়া নীতি বানিয়ে নিয়েছে ‘অর্থ না বুঝে তিলাওয়াত করলে কোন লাভ নেই।’
৩. কুরআন হিফাজতের ক্ষেত্রে শব্দাবলির হিফাজতের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই অর্থ ব্যতীত শব্দাবলিকেও হিফাজত করা আবশ্যক। আল্লাহ না করুক কোন জালিম সরকার লিখিত সমস্ত কুরআন জালিয়ে দিলেও একজন হাফিজে কুরআন তার স্মরণে রক্ষিত কুরআন দ্বারা পুনরায় লিখাতে পারবে। এক্ষেত্রে ছোটো একজন হাফিজ শিশুই যথেষ্ট। বড়দের প্রয়োজ নেই।
অভিজ্ঞতায় দেখা যায় শৈশবে কুরআন হিফজ করলে তা মজবুতভাবে স্মৃতিগত হয়; বয়ঃবৃদ্ধির পর হিফজ করলে মুখস্থ অক্ষুন্ন রাখা দুষ্কর হয়ে পড়ে। এখন তাদের কথামত শৈশবে কুরআন শিখানোর প্রচলন বন্ধ করে দিলে পরিণামে দুনিয়া থেকে হাফিজে কুরআনের মহান ধারা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই যারা অর্থ না বুঝে তিলাওয়াত করাকে অনর্থক বলে মানুষকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে তারা স্বয়ং আল্লাহর বিরূদ্ধে লড়াই করছে।
৪. শব্দের প্রতি রাসূল সা. অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। তাই উম্মতের জন্যও শব্দের প্রতি গুরুত্বারোপ করা কর্তব্য। তিনি শব্দের প্রতি এতো বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, অহী অবতরণকালে হযরত জীবরাঈল আ. এর সাথে দ্রুত আওড়াতেন। অথচ তাঁর স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিলো। এ থেকে তাঁর শব্দের প্রতি অসাধারণ আগ্রহ অনুধাবন করা যায়। এ ছাড়া রাসূল সা. এর শব্দের প্রতি এতো ব্যাকুল হওয়ার আর একটি প্রমাণ হলো তিনি নিজে তিলাওয়াতের পাশাপাশি অন্যের তিলাওয়াতও শুনতেন। একবার ইবনে মাসউদ রা.-কে বললেন, আমাকে কুরআন শুনাও। ইবনে মাসউদ রা. বললেন, আমি আপনাকে শুনাব! অথচ আপনার ওপরই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে? নবীজি সা. বললেন, আমি অপরের কাছ থেকে কুরআন শুনতে ভালোবাসি। [বুখারী : ৫০৪৯]
সুতরাং যারা বলেন অর্থ না জানলে কুরআন পড়ে লাভ নেই তাদের নিকট প্রশ্ন হচ্ছে, রাসূল সা. পূর্ণ কুরআনের হাফিজ এবং অর্থের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও কেন সাহাবীর তিলাওয়াত শুনতে চাইতেন? বুঝা গেল তিনি শাব্দিক তিলাওয়াতের প্রতিও অনুরাগী ছিলেন। তাই অন্যের পড়া শুনতে পছন্দ করতেন। এবং একথাও প্রমাণ হলো, অর্থ ছাড়া নিরেট শব্দ তথা তিলাওয়াতও মুখ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
৫. তিলাওয়াতের মাধ্যমে পরকালীন সফলতা অর্জন হয়।  তাই ‘অর্থ না বুঝে কুরআন তিলাওয়াত অনর্থক’ মন্তব্য বোকামি বৈ কিছু নয়। অর্থ বুঝার প্রয়োজনীয়তা তো আপনাদের নিকট স্বীকৃত। বর্তমান যুগে মানুষ বিজ্ঞান প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় এই উত্তরটি নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য অতি সহজ একটি দলীল। আর দীনদার লোকদের জন্য সহজবোধ্য আর একটি দলীল আছে। যারা কুরআন হাদীস বুঝতে চায় না তাদের নিকট এ উত্তর বিস্বাদ লাগবে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, কুরআন সহীহশুদ্ধ তিলাওয়াত করলে প্রতি হরফে দশটি করে নেকী লাভ হয়। [আত তারগীব আত তারহীব : ২২২৯]
৬. কুরআনের শব্দাবলিই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন। তাঁর পক্ষ থেকে প্রথমত শব্দাবলিই এসেছে। তারপর অর্থ এসেছে শব্দের অনুগামী হয়ে। এসূত্রেই শব্দাবলি যদি দুর্বোধ্য ভাষায় অবতীর্ণ হতো তবুও সেটাই যথেষ্ট হতো। প্রিয়জনকে খাবারের কিছু দেয়া হলে তাতে দুটি আকর্ষণীয় বস্তু থাকে। একটি প্রেমাষ্পদের হাতের ছোঁয়ার স্বাদ। অপরটি ভক্ষণের স্বাদ। প্রেমের প্রচলিত রীতি অনুসারে প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়াযুক্ত বস্তু নাগালে পাওয়াটাই আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় প্রিয়জনের স্পর্শমাখা বস্তুটি ব্যবহার না করে স্মৃতিস্বরূপ রেখে দেয়া হয়। অতএব আল্লাহ প্রেমিকদের আনন্দের উপলক্ষ্য হওয়ার জন্য কুরআনের শব্দাবলিই যথেষ্ট ছিলো। কারণ এগুলোই সর্ব প্রথম আল্লাহর সত্তা হতে নির্গত হয়ে অবতীর্ণ হয়। যেন এগুলোর অর্থই ছিলো না। পরে অবশ্য অর্থসহ অবতীর্ণ হওয়ায় দুটি স্বাদ একত্রিত হয়। সুতরাং অর্থের স্বাদ উপভোগের ছুতা দিয়ে শব্দের স্বাদ পরিত্যাগ করা অযৌক্তিক। উত্তরগুলো দিয়ে হযরত থানভী রহ. ঐসব লোককে সতর্ক করে দিলেন যারা নিজেরা তো কুরআন পড়েই না ওপরন্তু অন্যদেরকেও পড়তে বাঁধা দেয়। কুরআন হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য চিরস্থায়ী সংবিধান। এর মাধ্যমেই সবার জীবন গড়তে হবে। আর কুরআনের জন্য বিশুদ্ধ তিলাওয়াত এমনই এক শক্তি যা যে কোনো মানুষকেই প্রভাবিত করতে সক্ষম। তাইতো মক্কার কাফিররা প্রকাশ্যে কুরআনের বিরোধিতা করলেও রাতের বেলায় রাসূল সা. এর বাড়ির আড়ালে থেকে তাঁর কুরআন তিলাওয়াত শুনতো। সুতরাং যারা অর্থ না বুঝে কুরআন পড়াকে অনর্থক মনে করে তাদের উচিত কুরআনের ইতিহাস ভালোভাবে অধ্যয়ন করা। এবং না জেনে না বুঝে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তিতে না ফেলা। অন্যথায় আল্লাহর আদালতে জবাবদিহীর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
তথ্যসূত্র : [মুফতী আমিনী রহ. এর তিলাওয়াতে কুরআন অবলম্বনে]
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুনন্ধরা, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment