হযরত মুহাম্মদ (সা.) নারীমুক্তির পথিকৃৎ
।। সৈয়দ আশরাফ আলী ।।
আবহমানকাল থেকেই নারী অবহেলিতা, নির্যাতিতা, উপেক্ষেতা ও বঞ্চিতা। বর্তমান যুগের তথাকথিত ‘‘নারীমুক্তির’’ প্রবক্তাদের সংগ্রাম সত্ত্বেও সে করুণ দুর্দশার তেমন কোন উন্নতি সাধিত হয়নি। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে নারীকে সঠিক বা সুষ্ঠু কোন মর্যাদা প্রদান করা হয়নি। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের পরেও অমুসলিম দেশসমূহে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করার জন্য নারী জাতিকে সহ্য করতে হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী দুঃসহ লাঞ্ছনা, নির্যাতন ও অবমাননা। আজ Women’s Liberation বা নারীমুক্তির প্রবক্তা হিসাবে আমরা কেট মিলে, জার্মেন গ্রীয়ার বা অ্যান নূরাকীনের নাম উচ্চারণ করি। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি মেরী উলস্টোনক্রাফট অ্যানী বেসান্ত (Annie Besant), প্যাঙ্গহার্স্ট মারগারেট স্যাঙ্গার, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ মহীয়সী মহিলাদের বিরামহীন সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারী মর্যাদার জন্য যে ব্যক্তি প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠেন, নারীকে সংসার ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে যে ব্যক্তি প্রথম স্বীকৃতি দান করেন, সত্যিকার অর্থে নারী জাগরণ ও নারীমুক্তির যিনি প্রবক্তা, তিনি হচ্ছেন একজন পুরুষ ... সর্বযুগের, সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মানব সন্তান, আহমদ মুজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মহাপুরুষ যিনি নারী জাতিকে বস্ত্ততপক্ষে প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছেন।
জগতে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীকে বলা হতো ‘‘শয়তানের অঙ্গ’’, ‘‘দংশনের নিমিত্ত সদা-প্রস্ত্তত বৃশ্চিক’’, ‘‘বিষাক্ত বোলতা’’। নারী জাতির উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করেছেন সেন্ট বার্নাড, সেন্ট অ্যান্টনী, সেন্ট পল-এর মত বিশ্ববরেণ্য ধর্মযাজক ও পুরোহিতগণ। টারটুলিয়ানও নারীদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘‘তোমরা কি জান না যে, তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন ঊাব (বা মা-হাওয়া)? তোমাদের নারী জাতির উপর ঈশ্বরের দন্ডাদেশ আজও বলবৎ রহিয়াছে, সেই পাপ প্রবণতাও নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে বিদ্যমান। তোমরা নরকের দ্বারস্বরূপ ও নিষিদ্ধ বৃক্ষ সম্বন্ধে বিধিনিষেধ অমান্যকারিণী এবং ঐশ্বরিক বিধানের লংঘনকারিণী।’’ তাঁদের অভিমতে, ‘‘নারী যখন আদি পাপের উৎস, মানুষের জন্মগত পাপের কারণ, তখন সকল ভৎর্সনা, অবজ্ঞা ও ঘৃণা নারীরই প্রাপ্য।’’
ভারতেও নারীজাতির অবস্থা ছিল অতীব শোচনীয়। নারী পাপ-পঙ্কিল এবং পুরুষের চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতা ধ্বংসের মূল উৎস বলে বিবেচিত হতো। মনুর মতে নারীকে দিবা-রাত্রি অবশ্যই পুরুষের কড়া শাসনে রাখা আবশ্যক। কারণ, নারী জন্মগতভাবে দুশ্চরিত্র ও লম্পট। তাকে কঠোর শাসনে না রাখলে সে অবশ্যই বিপথগামী হবে।
বৈদিক সমাজে নারী ছিল অশুভ প্রাণীবিশেষ। অধ্যাপক ইন্দ্রেয় ভাষায়, ‘‘নারীর ন্যায় এত পাপ-পঙ্কিলতাময় প্রাণী আর নাই। নারী প্রজ্জ্বলিত অগ্নিস্বরূপ। সে ক্ষুরের ধারালো দিক। এ সমস্তই তার দেহে সন্নিবিষ্ট। নারীদের ভালবাসা পুরুষদের উচিত নয়।’’ (Prof. Indra, Status of Women in Mahabharat, P. 16)
চীনদেশে নারীর অবস্থা ছিল অধিকতর করুণ ও দুর্দশাগ্রস্ত। চীনের ধর্মগ্রন্থে নারী বর্ণিত হয়েছে ‘‘দুঃখের প্রস্রবণ’’ হিসাবে। অভিশপ্ত এই প্রস্রবণ সকল সৌভাগ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাদের অভিমতে, ‘‘নারী সর্বাপেক্ষা হতভাগ্য প্রাণী। জগতে নারী হইতে নিকৃষ্ট আর কিছুই নাই।’’
তথাগত বুদ্ধের শাশ্বত বাণী উপেক্ষা করে বিভ্রান্ত বৌদ্ধরা শিক্ষা দিত যে নারীর সাহচর্যে নির্বাণ লাভ করা চলে না। নারী সকল অসৎ প্রলোভনের যতগুলি ফাঁদ বিস্তার করিয়া রাখিয়াছে, তন্মধ্যে নারীই সর্বাক্ষো বিপদজনক। নারীর মধ্যে সকল মোহিনী শক্তি অঙ্গীভূত হইয়া আছে- যাহা সমগ্র বিশ্বের মনকে অন্ধ করিয়া দেয়।’’
বেটানীও (Betany) তাঁর World’s Religions গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘(বৌদ্ধরা মনে করতেন) অতলান্ত গভীরে মৎসের গতিবিধির ন্যায় অপ্রমেয় ও অবোধ্য, নারীর চরিত্র বহুবিধ ছলনায় আচ্ছাদিত। তাহার মধ্যে সত্য পাওয়া দুষ্কর। তাহার নিকট মিথ্যা সত্যসদৃশ এবং সত্য মিথ্যাসম।’’ (Bettany, as quoted in the Encyclopaedia Britanica, Vol. V. P.732)
ইহুদীরাও নারীকে সৃষ্টিকর্তার চিরন্তন অভিশাপ বলে গণ্য করতো। নারী থেকেই পাপের সূত্রপাত হয় এবং নারীর কারণেই সকলের ধ্বংস অনিবার্য। কারণ, নারীই সকল দুর্নীতির উৎস। ইহুদীদের সামাজিক প্রার্থনায় দশজন পুরুষের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক বিবেচিত হত। কিন্তু নয়জন পুরুষ ও বহুসংখ্যক নারী উপস্থিত থাকলেও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হত না। কারণ নারী মানুষরূপে পরিগণিত ছিল না।
সপ্তদশ শতাব্দীতে কাউন্সিল অব দ্য ওয়াইজ (Council of the wise) এর এক অধিবেশন রোম নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় :ুWoman has no soul” নারীর কোন আত্মা নাই।
ইসলাম এসব অলীক ও ভ্রান্ত ধারণা নস্যাৎ করে দিয়ে ঘোষণা করে যে, হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) উভয়কে শয়তান প্ররোচিত করেছিল। উভয়েই অনুতপ্ত হয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এবং রাববুল আলামীন, তাঁর সীমাহীন করুণায়, উভয়কে ক্ষমা করেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘‘এইভাবে সে (শয়তান) তাহাদিগকে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করিল। ... তাহাদের প্রতিপালক তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘‘আমি কি তোমাদিগকে এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইতে বারণ করি নাই এবং আমি কি তোমাদিগকে বলি নাই যে, শয়তান তো মোতাদের প্রকাশ্য শত্রু?’’
তাহারা বলিল, ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক। আমাদের নিজেদের প্রতি অন্যায় করিয়াছি। যদি তুমি আমাদিগকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইব।’’ (৭:২২-২৩)
ইসলাম একথাও সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, প্রত্যেক শিশু নিষ্পাপ হয়ে জগতে জন্মগ্রহণ করে এবং পাপ-পুণ্য কোন সহজাত সম্পদ নয়। পাপ-পুণ্য প্রত্যেক নর-নারীর অর্জিত বস্ত্ত।
যখন বিশ্বব্যাপী সকলেরই দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের ভোগের জন্য, তখন ইসলামের নবী (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন : ‘‘স্ত্রী হচ্ছে পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী। স্ত্রী হচ্ছে তার গৃহের সম্রাজ্ঞী।’’
শুধু তাই নয়, কুরআন মজিদে আল্লাহতায়ালা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এরশাদ করেছেন : ‘‘নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন আছে তাহাদের উপর পুরুষদের।’’ (২:২২৮)
ইসলামে নারীকে ‘‘মুহসানাহ’’ অর্থাৎ শয়তানের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সুরক্ষেত, দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বিধৃত রয়েছে : ‘‘তাহারা (অর্থাৎ তোমাদের স্ত্রীগণ) তোমাদের অঙ্গাবরণ এবং তোমরা তাহাদের অঙ্গাবরণ।’’ (২:১৮৭)
ইসলামের নবী (সা.) দ্বিধাহীনচিত্তে ঘোষণা করেছেন : ‘‘বিশ্বে বহু অমূল্য সম্পদ রহিয়াছে, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ধর্মপরায়ণ স্ত্রী।’’ একই সঙ্গে তিনি দাবি করেছেন : ‘‘তোমাদের মধ্যে তাহারাই উত্তম, যাহারা তাহাদের স্ত্রীদের সহিত উত্তম ব্যবহার করে।’’ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি উল্লেখ করেন : ‘‘তোমাদের মধ্যে উত্তম মানুষ তারা যারা নিজ স্ত্রীর দৃষ্টিতে উত্তম বলে গণ্য।’’(জামি তিরমিযী, ইমাম নববী, রিয়াযুস সালিহীন, পৃষ্ঠা ২৮৩)।
ইসলাম স্ত্রীদের সঙ্গে সর্বোত্তম ব্যবহারের তাগিদ প্রদান করেছে। সূরা নিসা-এর ১৯নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে : ওয়া আশিরু হুন্না বিল মা’রুফ (অর্থাৎ স্ত্রীদের সহিত দয়াও ন্যায়বিচারের সহিত জীবন যাপন করিবে।)
এমনকি নিজের স্ত্রীর জন্য ব্যয় করাও ইসলামের দৃষ্টিকোণে একটি মহৎ ও পুণ্যময় কাজ বলে বিবেচিত হয়। নবী করিম (সা.) এর ভাষায় : ‘‘যখন কোন মুসলিম পুণ্য লাভের আশায় তার স্ত্রীর জন্য কিছু ব্যয় করে তা একটি দানের সমতুল্য।’’ (বোখারী)।
স্ত্রীর অধিকার ও সম্মানের স্বীকৃতিসূচক নবী করিম (সা.)-এর বলিষ্ঠ ঘোষণা : ‘‘যে মুসলমান তাহার স্ত্রীর সহিত যত ভদ্র ও সদাশয়, তাহার ঈমান ততই পূর্ণতা লাভ করিয়াছে।’’
ইসলামের দৃষ্টিকোণে নারী যে কি সুমহান, উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত তা সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফূট হয় নারী চরিত্র সম্পর্কিত পবিত্র আল কুরআনের বলিষ্ঠ সতর্কবাণীতে :
‘‘যাহারা সাধ্বী রমনীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারিজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাহাদিগকে আশিটি কশাঘাত করিবে এবং কখনও তাহাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করিবে না; ইহারাই তো সত্যত্যাগী।’’ (সূরা নূর, আয়াত ৪)
কোন স্ত্রীর বিরুদ্ধে যদি ব্যভিচারের অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং কোন সাক্ষী না পাওয়া যায়, তাহলে সেই স্ত্রীর বক্তব্যের উপরেই নির্ভর করে তার অপরাধের সত্যতা। পবিত্র কুরআনের ভাষায় : ‘‘যাহারা নিজেদের স্ত্রীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অথচ নিজেরা ব্যতীত কোন সাক্ষী নাই, ... স্ত্রীর শাস্তি রহিত হইবে যদি সে চারিবার আল্লাহর নামে শপথ করিয়া সাক্ষ্য দেয় যে, তাহার স্বামীই মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবারে বলে তাহার স্বামী সত্যবাদী তাহার নিজের উপর নামিয়া আসিবে আল্লাহ পাপের গযব।’’ (সূরা নূর, আয়াত ৬, ৮, ৯)। ইসলামে সত্যিই সুউচ্চ আসন অধিকার করে আছে নারী।
ইসলামের নবী (সা.) নির্দেশ প্রদান করেছেন মাতা ও পিতা উভয়কে শ্রদ্ধা করতে, ভক্তি করযে, দু’জনেরই নি র্দেশ পালন করতে। কিন্তু একইসঙ্গে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একথাও তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ‘‘মায়ের পদতলেই বেহেশত অবস্থিত।’’
মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত- এ কথা পবিত্র হাদীসে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত রয়েছে্ কিন্তু স্বামীর পায়ের তলায় স্ত্রীর বেহেশত বর্তমান- এ হেন কোন উক্তি পবিত্র কুরআন ও হাদীসে কোথাও উল্লিখিত হয়নি। পুরুষ-শাসিত সমাজের এ এক স্বার্থান্বেষী আবিষ্কার।
সত্যিই ইসলাম নারী জাতিকে মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে- মা হিসেবে স্ত্রী হিসেবে, কন্যা হিসেবে।
শুধুমাত্র কথার কথা হিসাবে নয়, বাস্তব ক্ষেত্রেও নারী মর্যাদার এই স্বীকৃতি সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষেত হয়। ইসলাম ধর্মে প্রথম যিনি বিশ্বাস এনেছেন তিনি একজন নারী- বিধি খাদিজা (রা.)। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শাহাদাতবরণ যিনি করেছেন তিনিও একজন নারী- হযরত সুমাইল (রা.)। নবুয়তের কথা প্রথম যিনি জানতে পেরেছিলেন তিনিও একজন নারী- হযরত খাদিজা (রা.)। সৃষ্টির ইতিহাসে অদ্বিতীয় ঘটনা পবিত্র মিরাজ-এর কথা প্রথম যিনি জানতে পারেন তিনিও একজন নারী-বিবি উম্মা হানী (রা.)। সর্বকালের, সর্বযুগের মানুষের বংশধারা যাঁর মাধ্যমে রক্ষেত হচ্ছে তিনিও একজন নারী- বিবি ফাতেমা (রা.)। রাসূল (সা.) এর পারিবারিক জীবনের খুঁটিনাটি তথ্যাদি সুন্দর, সুষ্ঠুভাবে এবং সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যায় যেসব হাদীসে প্রতিফলিত হয়েছে তাও আমরা পাচ্ছি একজন নারীর মাধ্যমে- তিনি হচ্ছেন বিবি আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)। এমন কি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সঙ্কলিত যে ‘‘সহীফা’’ অবলম্বনে হযরত ওসমান (রা.) কুরআন শরীফের ঐতিহাসিক অনুলিপিসমূহ প্রণয়ন করেন, সেই ‘‘সহীফা’’ সংরক্ষেত ছিল একজন মহিলারই কাছে। উম্মুল মু’মেনিন হযরত হাফসা বিনতে ওমর (রা.)-এর নিকট সংরক্ষেত ‘‘সহীফা’’ অবলম্বনেই হযরত ওসমান (রা.) কুরআন মজিদের অনুলিপি তৈরি করেন।
এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা শুধুমাত্র কাকতালীয় যোগাযোগে নয়। এ সকল ঐতিহাসিক ঘটনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে কি অসাধারণ মর্যাদা ও গুরুত্ব ইসলাম নারীকে দিয়েছে।
ইসলাম নারীকে শুধু মর্যাদাই দেয়নি। বাস্তব ক্ষেত্রেও তাদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে্ ইংল্যান্ডের মত সুসভ্য দেশেও ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে MARRIED WOMEN’S PROPERTY ACT পাস হবার পর প্রথমবারের মত নারী জাতি পেয়েছে আইনগত ও অর্থনৈতিক অধিকার। কিন্তু তার চেয়ে ১৫শ বৎসর পূর্বেই নারীর আইনগত স্বাধীন সত্তা মেনে নিয়ে ইসলামের নবী (সা.) নারীকে SUI JURIS বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। নারীকে দিয়েছেন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের প্রতিটি পুরুষের সঙ্গে পূর্ণ অধিকার। ১৫শত বৎসর পূর্বেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত নির্ধারণ করে দিয়েছেন পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অংশ ও অধিকার। অ্যানী বেসান্ত (Annie Besant) তাঁর সুবিখ্যাত KAMJALA LECTURES - এ যথার্থই উল্লেখ করেছনুIn Islam men and women are put perfectly on equal footings. Mussalman women have been far better treated than the Western women by the law. By the laws of Islam her property is carefully guarded whereas christian women do not enjoy such absolute right according to the Laws of Christian West.”
ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে হযরত খাদিজা (রা.), হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হযরত ফাতেমা (রা.), বিবি সাকিনা (রা.) জুবাইদা, হামিদা, রাবেয়া বসরী (রা.), চাঁদ সুলতানা, সুলতানা রাজিয়া, জেবুন্নিসা প্রমুখ বিদুষী মহিলাবৃন্দ জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে অসাধারণ অবদান রেখে যাওয়া সত্ত্বেও এটি দুঃখজনক যে, আজ ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার ও ইসলামের অপব্যাখ্যার দরুণ মুসলিম মহিলাদের বিরাট এক অংশকে অমত্মঃপুরে বন্দী রেখে, সমাজের বিভিন্ন কার্যক্ষেত্রে অপাংক্তেয় করে রাখা হয়েছে।
অথচ, অ্যানী বেসান্তের ন্যায় বলিষ্ঠ, প্রগতিশীল অমুসলিম নারীও তাঁর উল্লিখিত ‘‘কমলা লেকচারাস’’-এ সাক্ষ্য প্রদান করেন :ুI often think that woman is more free in Islam than in Chrstianity.” সংসারের বিরাজমান এই কুসংস্কার ও ইসলামের অপব্যাখ্যা অপসৃত করে নারী জাতিকে দিতে হবে প্রতিভা বিকাশের ইসলাম-স্বীকৃত পূর্ণ অধিকার। শালীনতা ও আব্রু রক্ষা করে সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে বিচরণের অবাধ ও পূর্ণ স্বাধীনতা। মনে রাখতে হবে যে, ইসলামে পর্দা বলতে শুধুমাত্র নারীর পর্দাই বোঝায় না। ইসলাম দাবি করে যে, নারী ও পুরুষ উভয়েই সংযত ও পবিত্র জীবন যাপন করবে। শুধু নারীদিগকে দেহ আবৃত করতে ইসলাম নির্দেশ দেয়নি। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষনা করা হয়েছে : ‘‘বিশ্বাসী পুরুষদিগকে বল তাহারা তাহাদের দৃষ্টি নত করুক ও গুপ্ত স্থানগুলি আবৃত রাখুক, ইহাই তাহাদের জন্য পবিত্রতা।’’ (২৪:৩০)। নারীর পর্দা তার আবরণ, পুরুষের পর্দা চোখের মণিতে।
নারী স্বাধীনতা বা নারী জাগরণ বলতে অবশ্য ইসলাম নারীর বল্গাহীন, শরিয়ত-পরিপন্থী বিচরণের কেন স্বীকৃতি প্রদান করে না। পুরুষ থেকে নারীর বিচ্ছিন্ন রূপের সমর্থনও জানায় না। ইসলাম পরিপূর্ণভাবে সামাজিক ধর্ম বৈরাগ্যের ধর্ম নয়।ুwomen Lib” বলতে বর্তমান জগতে যা বোঝায় তা ইসলামের চিন্তা-চেতনায় বিধৃত নয়। সহাবস্থানের মাধ্যমে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও প্রীতি বিনিময়ে যে সুখপ্রদ, শান্তিময় পরিবেশ-পরিস্থিতির উদ্ভব ও বিকাশ এবং তৎসহ মর্যাদাদান, তাতেই কল্যাণ ও নারীর স্বাধীনতা বিদ্যমান বলে ইসলাম মনে করে।
একথা স্মর্তব্য যে, সম্মানীয় দূরত্ব বজায় রেখে, আত্মমর্যাদা, মান-সম্মান, ইজ্জত-আব্রু অক্ষুণ্ণ রেখে মুসলিম নারীরা সমাজ জীবনে প্রভূত অবদান রেখেছে। ইসলামে, লক্ষ্য করা যায়, নারী বীর বেশে যুদ্ধ করেছে, বিজ্ঞানচর্চা করেছে, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, পুরুষকে সাংস্কৃতিক চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে্ স্বমাহাত্ম্য বজায় রেখেই নারী এসব দায়িত্ব পালন করেছে। মানবজাতির ঘটনাবহুল ইতিহাসে মুসলিম নারীর অবদান অনস্বীকার্য।
প্রসঙ্গত : ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, শালীনতা ও আব্রু পরিপূর্ণভাবে অক্ষুণ্ণ রেখে মুসলিম মুহিলাগণ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি একই মসজিদে একই সঙ্গে নামায আদায় করেছেন। মসজিদে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে জনৈকা মহিলা প্রশ্ন করেছেন। দোর্দন্ড প্রতাপ ও নিবেদিতপ্রাণ খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা.)কে, বাধ্য করেছেন তাঁকে তাঁর ভুল স্বীকার করতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অন্ধত্ব, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার হয়ে নারীকে গৃহবন্দিনী বা গৃহের অন্তরালবর্তীনি হতে হয়েছে।
একটি কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, নারী করুণার পাত্রী নয়। সমাজ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই নারীকে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। একথাও মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান বিশ্বেও নারীর অবদান অসীম ও অতুলনীয়। FAO-এর একটি প্রতিবেদনে জানা যায় যে, পৃথিবীতে উৎপন্ন কৃষি শস্যের অর্ধেকেরও বেশি মহিলারাই উৎপাদন করে। কবি নজরুলের ভাষায়,
‘‘বিশ্বে যা- কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’’
এই বিপুল শক্তিকে অবমাননা করে নয়, বরং সম্মান প্রদর্শন করে,- সমঝোতা ও সহাবস্থানের মাধ্যমে মানবকল্যাণে সংলগ্ন করার মধ্যে, নারী জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা হবে।
নারী জাতির উন্নয়ন লক্ষক্ষ্য, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বহুবিধ বিধি-বিধান রচিত হয়েছে। কিন্তু, বস্ত্ততপক্ষে কোন বিধি-বিধানই সফলভাবে কার্যকর হয়ে উঠবে না যদি কিনা ইসলামের আলোকে সহমর্মিতা, উদার মনোভাব ও ঐকান্তিক শ্রদ্ধাবোধ সহকারে নারীর প্রকৃত মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য না রাখা হয়। পুরুষ কর্তৃক নারীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি বাস্তব স্বীকৃতি প্রদান ও সেই সঙ্গে নারীকে তার মর্যাদা লাভ ও অধিকার আদায়ের যোগ্যতা অর্জন- এই দু’য়ের মধ্যে যথাযথ ও অনাবিল সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। এ পথ অনুসরণেই আল্লাহতায়ালার একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃতি নারীর পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার সমাজের প্রতি অঙ্গ ও অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। অনুরণিত হবে মনীষী
Pierre Crabites এর অমর উক্তি। ‘‘Muhammad was greatest champion of women’s rights the world has ever seen.”
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
No comments:
Post a Comment