Saturday, May 31, 2014

পবিত্র কুরআনের আলোকে পর্দা

পবিত্র কুরআনের আলোকে পর্দা

 
সৈয়দা সুফিয়া খাতুন :
পবিত্র কুরআনের সাতটি আয়াতে মহিলাদের পর্দার বিধান বর্ণিত হয়েছে। চারটি আয়াত সূরা আহযাবে, তিনটি আয়াত সূরা নূরে বিবৃত হয়েছে। এসব আয়াতে পর্দার বিধি-বিধানের পূর্ণ বিবরণ বর্ণনা করা হয়েছে।
পর্দা সম্পর্কিত প্রথম আয়াত ঃ
“আর যখন নবীপতœীদের কাছে তোমরা কোন সামগ্রী চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে; এটি তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্র।” (আয়াত ৫৩, সূরা আহ্যাব)
আয়াতে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, নবীপতœীগণ তোমাদের সাথে পর্দা করবেন। তোমরা নবী পতœীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। তবে প্রয়োজনে কথা বলতে দোষ নেই; কিন্তু সামনাসামনি দেখা না হওয়া চাই। এটা তোমাদের এবং তাঁদের পবিত্র থাকার প্রকৃত উপায়। অর্থাৎ এ পর্যন্তু যেমন উভয় পক্ষের অন্তর পবিত্র, ভবিষ্যতেও যেন অপবিত্র হতে না পারে।
উল্লিখিত আয়াতের শানে নুযূলের বিবরণে বিশেষভাবে নবী পতœীগণের উল্লেখ থাকলেও এ বিধান সমগ্র উম্মতের জন্য ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। এ বিধানের সারমর্ম এই যে নারীদের কাছ থেকে ভিন্ন পুরুষদের কোন কিছু নেওয়া জরুরী হলে সামনে এসে নেয়া যাবে না, পর্দার আড়াল থেকে নিতে হবে বা কোন কিছু দিতে হলেও একইভাবে পর্দার যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে। এই বিধান পুরুষ ও নারী উভয়ের অন্তরকে মানসিক কু-মন্ত্রণা থেকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে।
এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, এ স্থলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পুণ্যাত্মা পতœীগণকে পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে, যাদের অন্তরকে পাক-সাফ রাখার দায়িত্ম  স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার। যেসব পুরুষকে সম্বোধন করে এ বিধান দেয়া হয়েছে, তারা হলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবায়ে কেরাম, যাদের মধ্যে অনেকের মর্যাদা ফেরেশতাদের নিকটও ঈর্ষণীয় ছিল। তাদের আন্তরিক পবিত্রতা থাকা সত্ত্বেও মানসিক কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর জন্য পুরুষ ও নারীর মধ্যে পর্দার ব্যবস্থা জরুরী করা হয়েছে। আজ এমন ব্যক্তি কে আছে, যে তার মনকে সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র মন অপেক্ষা এবং তার স্ত্রীর মনকে পুণ্যাত্মা নবীপতœীগণের মন অপেক্ষা অধিক পবিত্র হওয়ার দাবী করতে পারে? আর এটা মনে করতে পারে যে, নারীদের সাথে তাদের মেলামেশা কোন অনিষ্টের কারণ হবে না।
পর্দা সম্পর্কিত উল্লেখিত আয়াতের শানে নুযূল সর্ম্পকে ইমাম বুখারী (রহঃ) দুটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন- হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত এক রেওয়ায়েত হল, হযরত ওমর (রাঃ) একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! আপনার কাছে সৎ-অসৎ অনেক রকমের লোক আসা-যাওয়া করে, আপনি পতœীগণকে পর্দা করার আদেশ দিলে খুবই ভাল হত। এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্দার আয়াত নাজিল হয়।
পর্দা সম্পর্কিত দ্বিতীয় আয়াত ঃ
মহিলাদের ঘর হতে বের হওয়ার নিয়মাবলী সম্পর্কিত উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে- হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিন নারীদেরকে বলে দিন তারা যেন তাদের চাদর নিজেদের মুখের উপর নামিয়ে দেয়। (আয়াত ৫৯, সূরা আহ্্যাব)
আলোচ্য আয়াতের সারমর্ম হলো যে, মহিলাগণ সমস্ত শরীর ঢাকার সাথে সাথে চাদরের একাংশ মুখের উপর ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
হাদীসে বর্ণিত আছে, এই আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর মুসলিম নারীগণ মুখমণ্ডলসহ গোটা দেহ এমনভাবে ঢেকে বের হতেন যে, দেখার জন্য শুধু একটি চোখ খোলা রাখতেন। এতে প্রমাণিত হয়, ফেৎনার সময় মুখমণ্ডলও ঢেকে রাখা স্বাধীন নারীদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। একান্ত ঠেকাবশতঃ দাসীদের জন্য তা জরুরী নয়। কারণ, এতে তাদের কাজ-কর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
আলোচ্য আয়াতে এ শিক্ষাও দেয়া হয়েছে, সফর কিংবা অন্য প্রয়োজনে যদি ঘর থেকে বের হতে হয় তখনও মহিলাগণ পর্দা ত্যাগ করতে পারবে না; বরং সমস্ত শরীর আবৃত করার সাথে সাথে চাদর কিংবা বোরকা দ্বারা মুখমণ্ডল এমনভাবে ঢেকে নিতে হবে যেন কেউ দেখতে না পায়।
এ আলোচনার পর মহিলাদের জন্য মুখমণ্ডল ঢেকে চলা ফরজ কিংবা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই।
কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সর্বদা ঘরে অবস্থান করাই মহিলাদের জন্য মূল বিধান। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, (হে নারী সকল!) তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর।  (আয়াত ৩৩, সূরা আহ্যাব)
কিন্তু যদি কখনও ঘর থেকে বের হওয়ার কিংবা পর-পুরুষের সামনে আসার শরয়ী কিংবা স্বভাবগত কোন প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে প্রয়োজন পরিমাণ প্রকাশ করতে পারবে। স্বভাবগত প্রয়োজন যেমন-বিশেষ প্রয়োজনে কোন আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া কিংবা পুরুষ লোক বা কর্মচারীর অভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করার জন্য বাজারে যাওয়া ইত্যাদি। তবে লম্বা চাদর কিংবা বোরকা দ্বারা আপাদমস্তক ঢেকে বের হতে হবে। পর্দার সাথে এসব কাজ আঞ্জাম দিতে কোন অসুবিধা নেই।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা যেন তাদের চাদরের একাংশ তাদের (মুখমণ্ডলের) উপর ঝুলিয়ে রাখে। আর যদি পর্দার সাথে প্রয়োজনীয় কাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব না হয়, তাহলে প্রয়োজন অনুসারে পর্দা খোলা জায়েয আছে। যেমনঃ ডাক্তারকে যদি হাতের শিরা দেখানোর প্রয়োজন হয় কিংবা যদি দেহের অন্য কোন স্থানে এমন রোগ দেখা দেয় যে, কাপড়ের উপর থেকে দেখে তার চিকিৎসা করা সম্ভব না, তাহলে প্রয়োজনীয় স্থানটুকু খুলে ডাক্তারকে দেখানো জায়েয আছে। কারণ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ কাজও প্রয়োজন পরিমাণ বৈধতা প্রাপ্ত হয়।
শরয়ী জরুরত যেমনÑ সাক্ষ্য দেয়ার জন্য কাজী কিংবা জজের সামনে উপস্থিত হওয়া। এমতাবস্থায় মুখমণ্ডল খোলা রাখার অনুমতি রয়েছে। অনুরূপভাবে কোন কাফের কিংবা ডাকাত যদি কোন মহিলার ঘরে হামলা চালায়; তাহলে রক্ষার জন্য তাদের মোকাবেলা করা যাবে। মহিলা সাহাবীগণ এ ধরনের পরিস্থিতিতে জেহাদে অংশগ্রহণ করতেন কিন্তু তাঁরা অবাধে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেন না। মোটকথা, পর্দার সাথে চলা এবং ঘরের চৌহদ্দীতে অবস্থান করাই মহিলাদের জন্য আসল বিধান। কিন্তু প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন অনুযায়ী পর্দা হতে বের হওয়ার অনুমতি আছে। প্রয়োজনের অধিক বেপর্দার সাথে গায়রে মাহরামের সামনে যাওয়া সম্পূর্ণ হারাম। পর্দা সম্পর্কে ইসলামী বিধানের সারমর্ম ইহাই।
উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘তারা যেন তাদের চাদরের একাংশ তাদের মুখমণ্ডলের উপর ঝুলিয়ে রাখে’। এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর আনসার মহিলাগণ কালো চাদর পরিধান করে প্রয়োজনে এমনভাবে বের হতেন যে, মনে হত তাদের মাথায় কাক বসে আছে।

মুসলিম বালককে দেখে খ্রিস্টান প্রশিক্ষকের ইসলাম গ্রহণ

মুসলিম বালককে দেখে খ্রিস্টান প্রশিক্ষকের ইসলাম গ্রহণ

 
আবু আফিফা :

ফিলিপাইনের জাতীয় সাঁতার দলের প্রশিক্ষক, ম্যালিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানের ওপর ডিগ্রি নেয়া ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম এরসিনাস তার ইসলাম গ্রহনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে:
আল্লাহর অসংখ্য প্রশংসা, (এরসিনাস) খ্রিস্টান পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে তিনি আমাকে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সৌভাগ্যে ভূষিত করেছেন। আমার জন্ম ও শিক্ষা রাজধানী ম্যানিলার এক খ্রিস্টান পরিবেশে। এখানে  কোনো মুসলিম নেই। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলগুলোতেই মুসলিমদের অবস্থান সীমাবদ্ধ। বাল্যকালে আমার পরিবার চাইত, গির্জায় আমি যেন বেশি বেশি সময় দিই। আমি যখন যৌবনে পা রাখলাম, গির্জায় যেতে কোনো আগ্রহ বোধ করছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নিজ ধর্ম খ্রিস্টবাদ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম। এ সম্পর্কে বিস্তর পড়াশোনা শুরু করলাম। দেখলাম, ধর্মমতের ব্যাপক বিভক্তি থাকলেও আল্লাহর একত্ববাদে ঈমান না আনার বেলায় এরা একাট্টা। শিক্ষাজীবন শেষে সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে আমি সৌদি আরব গেলাম। এই প্রথম আমার মুসলিমদের সংস্পর্শে আসা। মিডিয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলমানদের একটি উগ্রতম গোষ্টী হিসেবে তুলে ধরে। আল্লাহর অসংখ্য শুকরিয়া, আজ আমি যাদের একজনে পরিণত হয়েছি। সেই মুসলিম ভাইদের কারও প্রতি কখনও অস্ত্র তাক করিনি।
আমি সৌদি আরবে যাওয়ার পরেই কেবল মুসলমান সম্পর্কে জানতে পারি। আমি যাদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিতাম, তাদের মধ্যে ছিল একটি ছেলে। ওর বয়স অনুর্ধ্ব তেরো। খুদে এই মুসলিমের চলাফেরা ও কাজ-কর্মে দেখতাম এক কঠোর নিয়মানুবর্তিতা। ও ছিল শান্ত স্বভাবের। জীবন যাপন সুশৃঙ্খল। আমাকে দেয়া প্রতিশ্রুতির অন্যথা করেনি সে কখনও। যথাসময়ে নামাজ
আদায়ে তার ভক্তি ও নিষ্ঠা ছিল চোখে দেখার মতো। অবসরের সিংহভাগ সময়ই কাটাত তার নিবিষ্ট মনে কোরাআন তেলাওয়াতে।
মুসলিম সেই বালকটির ছিল তীক্ষè মেধা, সেই সঙ্গে ছিল তার বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। আমি তার কর্মকান্ডের প্রতি লক্ষ্য করেছি, তার সঙ্গ আমাকে আনন্দ দিচ্ছে- এতটুকু বুঝতে পেরেই সে আমার সামনে একগাদা ইংরেজিতে অনূদিত ইসলাম ও তুলনামূলক ধর্মতত্বের বই উপাস্থাপন করল। ইংরেজী অনুবাদসহ কোরআন শরীফের একটি কপিও দিল। যত পড়লাম আমার সামনে একে একে অজানা জগত উদ্ভাসিত হতে লাগল। আমি বা আমার মতো অন্য কেউ এ জগতের সন্ধান পাননি। এসব পড়ে আমি অত্যন্ত প্রভাবিত হলাম, বিশেষ করে যখন কোরআন শরীফের তরজমা পড়লাম। এই কিতাবে যে একক স্রষ্টার কথা বলা হয়েছে, তা আমার চিন্তার সঙ্গে মিলে গেল। এ চিন্তায় আমি খুব তৃপ্তি ও স্বস্থি বোধ করলাম। এরপর আমি প্রবলভাবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। এমনকি আমি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার আগেই নিজের নতুন নামও (আব্দুল করিম) ঠিক করে ফেললাম। আসলে ইসলামের সঙ্গে আমার এই পরিচয়ের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহের পর এই বালকটির প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ। এই পরিচয়ের পরই শুরু হয় হেদায়েতের পথে আমার অভিযাত্রা।
আমি খুব গরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন দেখতে লাগলাম আমার সহকর্মীদের সময়মতো নামাজ পড়া। আমার কর্মক্ষেত্রেই ছিল মসজিদ। আমি পর্যবেক্ষণ করতাম তাদের নামাজ। কী বিস্ময়কর, তন্ময়তায় তারা নামাজে নিমগ্ন হতো। সবাই একসঙ্গে রুকু করছে, সিজদা করছে। একই ইমামের পেছনে সবাই কত শৃঙ্খল ও গুরুত্বের সঙ্গে নামাজ আদায় করছে।
আমার কর্মস্থলের বন্ধুরাও অনুদারতা দেখাননি। তারা আমাকে জেদ্দায় রাখা এই বালকের মতোই সহযোগিতা করেছেন। যথাযথ যতœ-আত্তি করেছেন। তারা যখন আমার ইসলাম সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা, ইসলাম নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা এবং নামাজের ব্যাপারে আমার অত্যন্ত কৌতুহল লক্ষ্য করলেন, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু কিতাব পড়তে দিলেন। তাদের দেয়া গ্রন্থগুলোর মধ্যে ছিল আহমদ দিদাতের পাদ্রিদের সঙ্গে সংলাপের বই। সিজওয়ার্টের সঙ্গে আহমদ দিদাতের বিতর্ক অনুষ্ঠানের বই আমার মনে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করল। বর্ণনা আর যুক্তি কোনোটির অভাব নেই তাতে। এসব বর্ণনা ও যুক্তিগুলো পড়ে আমি খুব উৎসাহ বোধ করি। অপরদিকে সিজওয়ার্টাকে মনে হতে থাকে পরাজিত ও বিষণœ। তার প্রতিক্রিয়াগুলো যেন আর্তমানুষের প্রতিক্রিয়া। তার অবস্থান যে ভ্রান্তির পক্ষে, মুসলমানদের আগে তা খ্রিস্টানও বুঝতে পারছিল। একপর্যায়ে আমি আহমদ দিদাতের কাছে চিঠি লিখলাম। এতে আমি তার যুক্তির শাণিত অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অসাধারণ ক্ষমতার প্রশংসা করলাম। তার কাছে এ ধরনের অসত্য থেকে সত্য উন্মোচনকারী বার্তা ও সংলাপের বেশি বেশি বই চাইলাম।
এরপর আমি খ্রিস্টান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। এ উদ্দেশ্যে আমার সহকর্মীদের কাছে এজন্য আমার করণীয় কী, জানতে চাইলাম। আর সেদিনই আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর ওপর, তাঁর রাসূলের ওপর এবং শেষ দিবসের ওপর। বিশ্বাস স্থাপন করলাম জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কেও। সে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি।
আমি নিজের অপরিমেয় সৌভাগ্য অনুভব করলাম। আজ অনুগত মুসলিম হিসেবে জীবন যাপন করি। আমি সালাত আদায়ে মসজিদে যাই। সেখানে সিজদাবনত হয়ে এক অপার্থিব তৃপ্তি ও সুখ অনুভব করি। জীবন যাপনেও তেমনই অফুরন্ত প্রশান্তির আস্বাদ পাই। আমার অতীত জীবন ছিল বিশৃঙ্খল আর উদ্দেশ্যহীন হট্টগোলপূর্ণ। আল্লাহ আমাকে সে অবস্থার বদলে আজ আলো, শৃঙ্খলা, সচ্চরিত্র ও মূল্যবোধের জীবন দান করেছেন। সন্দেহ নেই, ইসলাম অনেক মহান ধর্ম। ইসলামে দিক্ষিত হতে পেরে আমার জীবন ধন্য হয়েছে।

সামাজিক সংস্কার ও দায়বদ্ধতা

সামাজিক সংস্কার ও দায়বদ্ধতা

[এক] ব্যপক সংস্কারের প্রয়োজনে বিশিষ্ট নবীর জন্যে বিশেষ বিবাহ নীতি:
আল্লাহ তা’য়ালার অন্য সব নবী-রসূলদের মত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-ও একজন মানুষই ছিলেন। তিনি আর সব মানুষের মতই খাবার খেতেন, হাটে-বাজারে যেতেন। অন্যসব মানুষের মতই তাঁর মধ্যেও সমস্ত মানবিক গুণাবলী যেমন আবেগ-অনুভুতি, দুঃখ-সুখ, আশা-নিরাশা সবই ছিল (সূরা ১৬: আয়াত ৪৩; ২৫:২০)। কিন্তু তারপরও তিনি ছিলেন বিশিষ্ট মানব এবং অনন্য আত্মিক ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।
আল্লাহর ওহীকে নিজের মধ্যে ধারন করার জন্য বিশেষ শক্তি ও সামর্থ্য ছিল রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর। বিষয়টা খোলাসা করা হয়েছে একটা প্রত্যক্ষ ঘটনার মাধ্যমে। সহী বোখারী শরীফে বর্ণিত সুবিখ্যাত ঐ ঘটনা থেকে জানা যায় যে একদিন এক মজলিসে বসা অবস্থায় রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাঁটু লেগেছিল সাহাবী হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ)-এর হাঁটুর সাথে। ঠিক সেই সময় রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর নাযিল হওয়া শুরু করে আল্লাহর ওহী। ঐ মুহুর্তের কথা বলতে গিয়ে সাহাবী হযরত যায়েদ (রাঃ) বলেন, ‘মনে হচ্ছিল আমার পায়ের হাড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, অসম্ভব ছিল সেই ব্যথ্যার ভার সহ্য করা’।
উল্লেখ্য শুধু ঐ একটি দিনের সামান্য একটি মুহুর্ত মাত্র নয় বরং পুরো তেইশটি বছর ধরে সেই ভয়ানক ভারবাহী ওহী নাযিল হয়েছিল রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপরে। ওহীর দুঃসহ ভার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাক বলেন, ‘যদি এই আদেশ পাহাড়ের উপর নাযিল করা হতো তাহলে এর ভারে পাহাড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেত’ (৫৯:২১)। তাই আল্লাহ পাকের ওহীকে ধারণ করার প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের চাইতেও অনেক বেশী শারীরিক শক্তির অধিকারী করে গড়া হয়েছিল রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে। তাঁর শারীরিক শক্তিমত্তার কথা বলতে গিয়ে নবীজী (সাঃ) নিজেই বলেছেন যে তাঁকে ত্রিশজন পূর্ণ স্বাস্থ্যবান যুবকের শক্তি পরিমাণ সামর্থ্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে (বোখারী, মুসলিম)।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই অতিমাত্রিক দৈহিক যোগ্যতার প্রামাণ মেলে তাঁর ইবাদত বন্দেগীর পরিমাণ ও পদ্ধতির মধ্যেও। উল্লেখ্য রসূল (সাঃ) কখনও কখনও একাধারে রোজা রাখতেন। প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবারা বলেন, দিনের পর দিন পার হয়ে যেত কিন্তু তিনি রোজা ছাড়তেন না। দেখে মনে হতো তিনি হয়তো আর কখনই রোজা রাখা বন্ধ করবেন না (বোখারী, মুসলিম)। সাহাবারা আরও বলেন, ‘নবীজীকে একাধারে রোজা রাখতে দেখে আমরাও তাঁকে অনুসরণ করা শুরু করতাম। কিন্তু তিনি নিষেধ করতেন, বলতেন যে তাঁকে আমাদের চাইতেও অনেক শক্তিশালী করে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং ঐ বাড়তি রোজা তাঁর জন্যে তাঁর শক্তির অনুপাতে অতিরিক্ত ইবাদত’ (বোখারী)।
হযরত আয়েশা (রাঃ) কাছ থেকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর রাত্রিকালীন দীর্ঘ নামজের যে সব বর্ণনা পবিত্র হাদীস গ্রন্থগুলোতে দেখা যায় তাও বস্তুতঃ তাঁর শারীরিক শক্তি-সামর্থ্যের আনুপাতিক। নিজের উম্মতকেও তিনি সেই উপদেশই দিয়ে গেছেন, বলেছেন নিয়মিত ফরজ ইবাদতের বাহিরে অতিরিক্ত যে কোন ইবাদত করার ক্ষেত্রে নিজের সামর্থ্যের সীমা অতিক্রম না করতে এবং সামান্য হলেও নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে নেয়া সুবিধাজনক সেই বাড়তি ইবাদতগুলোতেই নিয়মিত থাকতে (বোখারী)।
এই তথ্যগুলো থেকে এটা স্পষ্টতঃই বলা চলে যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)- কে একাধিক বিয়ের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অতিরিক্ত শারীরিক শক্তিমত্তার বিষয়টা বিবেচনা করাই আল্লাহ পাকের জন্য যথেষ্ট হতে পারত কিন্তু সূক্ষ্মদর্শী মহান আল্লাহ তা’য়ালা পর্যাপ্ত কারণ থাকার পরও সে পথে যাননি আর তাই প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স অবধি নবীজীর স্ত্রী ছিলেন মাত্র একজনই। এরদ্বারা আল্লাহ পাক বস্তুতঃপক্ষে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন নিজেদের সহজাত রীপুকে নিয়ন্ত্রনে রাখার উপযোগিতা ও কৌশল। তাই রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অতিরিক্ত বিয়েগুলো যে শুধুমাত্র উম্মতের শিক্ষার প্রয়োজনেই হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
উপরন্তু আল্লাহ পাক উম্মতী মুহাম্মদীকে যে প্রয়োজন স্বাপেক্ষে চারটা পর্যন্ত বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন (৪:৩) তার ব্যবহারিক নমুনা ও উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্যেও রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একাধিক বিয়ে অপরিহার্য ছিল। সে লক্ষ্যেই নবীজীর জন্যে গ্রহণ করা হয়েছিল সাধারণদের থেকে ভিন্ন বিশেষ বিবাহ নীতি (৩৩:৫০)। এর কারণ হলো আল্লাহ পাক তাঁর বিধি-বিধানগুলোকে কখনই শুধুমাত্র থিওরীর মধ্যে সীমিত রাখেননি। সেসব যে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ সম্ভব তাও সব সময়ই দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা অতি প্রত্যক্ষ ভাবে, ব্যবহারিক প্রমাণপঞ্জীর দ্বারা। তাই রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পুরো মিশনকে না বুঝে তাঁর বহু বিবাহের মর্ম উপলব্ধি করা একেবারেই অসম্ভব।
[দুই] সুস্থ সমাজ বিকাশে চাই শুদ্ধ বিবাহ:
আল্লাহ পাকের অন্যান্য নবী-রসূলদের মত রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ই ছিল তাঁর সুবিস্তৃত মিশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্য নবীদের মত তাঁর মিশনেরও টার্গেট ছিল সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে ঢুকে পড়া মানুষের কল্পনাপ্রসূত অজ্ঞতাগুলোকে টেনে বের করে সমাজকে আবার তার বিশুদ্ধ ভিত্তির উপর দাঁড় করানো। অনেকটা আগাছাময় ফসলের জমিতে দক্ষ হাতে নিড়ানী দেয়ার মত। অপ্রতিরোধ্য আগাছা যেমন প্রকৃত ফসলকে বাড়তে দেয় না তেমনি অজ্ঞতা নির্ভর সমাজের বুকেও কাজ করে না কোন সত্য বিধান। বরং অজ্ঞতার আগাছাকেই তখন ফসল ভেবে ভুল করতে থাকে সবাই।
নারী-পুরুষের বিয়ে হলো মানব সমাজের যথার্থ বিকাশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক জমিন। বস্তুতঃ এই জমিনের শুদ্ধতার উপরই নির্ভর করে মানুষের অন্য ক্ষেত্রগুলোর শুদ্ধতা ও সফলতা। তাই আল্লাহ পাকের নবীরা যে এই ক্ষেত্রটাকে অজ্ঞতা মুক্ত করতে অগ্রণী হবেন সেটাই স্বাভাবিক। এটা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্যে ছিল আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাঁর পরে পৃথিবী ধ্বংস অবধি আর কেউ আসবে না নিড়ানী দিয়ে এই জমিন পরিষ্কার করতে। বরং পদার্থ ভিত্তিক সক্ষমতার ব্যপক প্রসারে নবীজী উত্তর এই জমিন হবে এমনই আগাছাময় যে অর্থপূর্ণ জীবনধারণ এখানে ক্রমেই হয়ে পড়বে খালি পায়ে জলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে হাঁটার মতই দুরূহ ও কষ্টসাধ্য।
আরবের তৎকালীন ভয়ানক অজ্ঞতাময় পরিস্থিতিতে যেখানে কন্যা সন্তানকে জন্মমাত্রই মাটিতে পুঁতে হত্যা করার মত মর্মন্তুদ ঘটনাও ঘটছিল অহরহ সেখানে মেয়েদের বিয়ের বিধানসমূহ যে কি রকম শোষণের হাতিয়ার ছিল তা অনুমান করা যায় সহজেই আর পুরো সমাজের বিরূদ্ধে ও বিপরীতে গিয়ে সেসবের সংস্কার যে ছিল আরও ঝুঁকিপূর্ণ তাও বলাই বাহুল্য। অথচ মানুষের প্রয়োজনে আল্লাহ পাকের সত্য বিধানসমূহের ব্যবহারিক নমুনা সৃষ্টি করতে গিয়ে নবীজী (সাঃ)-কে একক ভাবেই নিতে হয়েছিল সেই সব ঝুঁকি, একাকী দাঁড়াতে হয়েছিল পুরো পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিরূদ্ধে।
আল্লাহ পাকের বিধি-বিধানগুলো স্বয়ং নবীজী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তাঁর বিভিন্ন বিয়ে নিয়ে এখনও যেভাবে প্রশ্ন তোলা হয় তাতে এসব বিয়ের কিছু উদাহরণ যদি নবীজী ছাড়া অন্যান্য সাহাবীদের দিয়ে সৃষ্টি করা হতো তাহলে আমরা আজকের দিনের দুর্বল চিত্তের উম্মতেরা বিবিধ ব্যাখ্যাকারীদের দ্বারা যে কি ভাবে বিভ্রান্ত হতাম তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
[তিন] বিয়ের বয়স, দায়িত্ববোধ এবং বালিকা বধূঃ
রসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ তা’য়ালার সর্বশেষ রসূল হবেন এটা যেহেতু পূর্ব নির্ধারিত ছিল তাই জন্মাবধি তিনি যত কাজই করেছেন তার সবই ছিল আল্লাহ পাকের বিধান মত এবং সেগুলোও এই উম্মতের জন্য নবীজীর সুন্নত হিসেবে অণুকরনীয় যদিও সেসব ছিল তাঁর নবুয়ত লাভের পূর্বের ঘটনা বা বিষয়। এই হিসেবে একজন পুরুষের জন্য বিয়ের আদর্শ বয়স হলো পঁচিশ তথা যৌবনের প্রাথমিক কাল যার ইঙ্গিত পাওয়া যায় পবিত্র আল-কোরআনেও (৪:৬)। এই বয়স কালের মধ্যে হবু বরের উপার্জন করতে পারাটাও উত্তম যদিও অর্থ কষ্টের মাঝেও আল্লাহ পাক বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন যে বিয়ের কারণে আল্লাহর যে রহমত লাভ হবে তাতে দূর হয়ে যাবে অভাব-অনটন (২৪:৩২~৩৩)। তবে যে কোন বিবেচনাতেই, যত সামান্যই হোক না কেন, নিজে উপার্জন করে পরিবারের জন্য ব্যয় করতে পারে বলেই পুরুষকে দেয়া হয়েছে নারীর উপরে শ্রেষ্ঠত্ব ও অধিকার (৪:৩৪)। তাই বয়স এবং পরিবার পালনের আর্থিক সক্ষমতা এই দুই ক্ষেত্রেই রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন পৌঁছে ছিলেন আদর্শ অবস্থায় ঠিক তখনই তাঁর বিয়ে হয় চল্লিশ বছর বয়স্কা বিধবা নারী হযরত খাদিজা (রাঃ) সাথে।
এখানে লক্ষ্যনীয় যে বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষের বয়স ও আর্থিক সঙ্গতি বিবেচ্য হলেও নারীর ক্ষেত্রে এই দুটোর কোনটাই বিবেচ্য বিষয় নয়। ব্যপারটা পরিষ্কার করা হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে রসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক ছয় বছরের বালিকা হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে বিয়ে করার মাধ্যমে। সাধারণতঃ বিয়ের কনে হয়ে থাকে বরের চেয়ে কম বয়স্ক। বয়সের এই হিসেবকে স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক সম্পর্ক বিনির্মাণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই দুই বিয়েতেই সমাজের সেই কথিত ধারা ও ধারণাকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রাধান বিবেচ্য হতে হবে সুদূরপ্রসারী পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা, অন্য কিছু নয়।
বিয়ে মানেই সামাজিক দায়বদ্ধতা, এই মূল নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েই মদিনার আনসারেরা তাদের সম্পদের সাথে সাথে একাধিক স্ত্রীদের মধ্য থেকেও ভাগ দিয়েছিলেন মক্কা থেকে আগত মুজাহিদ ভাইদেরকে যাতে মদিনার বুকে তারা জীবন শুরু করতে পারেন নতুন ভাবে। এই একই দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যুদ্ধলব্ধ শত্রু পক্ষের নারীদের ক্ষেত্রেও। এই ধরনের নারীদেরকে ‘নিজেদের করে নেয়ার’ অনুমতি মুসমানদেরকে আল্লাহ পাক দিয়েছেন (৪:২৪; ৬০:১০)। আল্লাহর এই বিধান বহু বিজ্ঞজনের মহা শিরপীড়ার কারণ। তারা দেখেও দেখেন না যে রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের রাষ্ট্রে কিভাবে এই আদেশের বাস্তবায়ন করেছিলেন।
উল্লেখ্য মদিনার মুসলিম বাহিনীই ছিল জগতের একমাত্র স্শস্ত্রবাহিনী যারা যুদ্ধলব্ধ নারীদের ‘গণভোগ’কে হারাম ঘোষণা করে বাহিনীর সিদ্ধান্ত মতে ইসলামী আইন অনুযায়ী তাদেরকে বিয়ে করে নিজেদের পরিবারভুক্ত করে নিয়েছিলেন। এই পদ্ধতিতেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পরিবারভুক্ত হয়েছিলেন হযরত জাওয়ারিয়া ও হযরত সাফিয়া (রাহাঃ)। আল্লাহর আলোচ্য আদেশের এই যে অর্থ রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন এর বাহিরে ঐ আয়াতের অন্য কোন অর্থ করার যে কোন চেষ্টা হবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে আলাদা ভাবে চিন্তা করার সামিল যার কোন অবকাশই ইসলামে নেই।
এমনই দায়িত্বশীলতার আরেক আদেশে আল্লাহ পাক মুসলিম পুরুষদেরকে অনুমতি দিয়েছেন এখনও ‘মাসিক শুরু হয়নি’ এমন বালিকাদেকে বিয়ে করার জন্য (৬৫:৪)। বলাই বাহুল্য ইসলামকে আক্রমণ করতে মাত্রাধিক হারে ব্যবহূত হচ্ছে এই আয়াত। বস্তুতঃ এই আয়াতেরই সফল বাস্তবায়ন ছিল রসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক ছয় বছরের বালিকা হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বিবাহ, যা কিনা আল্লাহর ঐ আয়াতের মতই বহু বিতর্কিত এবং বহুল আলোচিত। এই সব অযাচিত তর্ক-বিতর্কের অবসানে প্রয়োজন এই বিষয়ের উপর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ যেখানে আমাদেরকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে পুরো ইসলামে নারীর অবস্থান ও মূল্যায়ন।
লক্ষ্যনীয় যে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার কোন পর্যায়েই, কোন ভাবেই নারীকে কখনও একাকী ছেড়ে দেয়া হয়নি। নারীকে সব সময়ই রাখা হয়েছে মাহরাম পুরুষ তথা যাদের সাথে বিয়ে হারাম তাদের সাথে অথবা স্বামীর সাথে। নারীর নিরাপত্তাকে দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ প্রাধান্য, তাকে রাখা হয়েছে সর্বদা সুরক্ষিত। একাকী নারী জীবনের তাই দেখা মেলে না ইসলামী বিধানে। এই যদি হয় নিয়ম তাহলে কি উপায় হবে পিতা-মাতাহীন এতিম বালিকাদের? যে কোন সময় পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন সমাজে পাওয়া যেতে পারে এমন কন্যা। এমন হওয়াও বিচিত্র নয় যে দুর্যোগ, দুর্বিপাক অথবা মহামারীতে আক্রান্ত পিতা-মাতা বয়স-কাল সব উপেক্ষা করে জীবনের প্রয়োজনে বাধ্য হতে পারে কন্যা সম্প্রদানে। সেসব ক্ষেত্রে কি হবে ইসলামের বিধান? বস্তুতঃ সেই বিধানই প্রকাশিত হয়েছে আল-কোরআনের ঐ আয়াতে (৬৫:৪) যার বাস্তব রূপ হলো রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঘরে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর স্ত্রী হয়ে আসা। এই বিয়ের দ্বারা কনের বয়স নূন্যতম কত হলে তাকে বিয়ে দেয়া যেতে পারে তারও একটা ধারণা দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য আজকের দুনিয়ায় ষোল, আঠারো, একুশ ইত্যাদি বয়সকে ‘সাবালক’ বা ‘ম্যাচিউরিটি এজ’ এবং এর নীচের বয়সকে ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’ ধরা হয়। অথচ এর কোনই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারণ বালিকা বয়সের মেয়েরা যদি ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’ হয় তা হলে অহরহ তারা মা হচ্ছে কিভাবে? কিশোর ছেলেরা বাবা হচ্ছে কিভাবে? এমনকি অতি সম্প্রতি পৃথিবীর প্রথম কিশোরী নানীরও সন্ধান পাওয়া গেছে পশ্চিমা কোন এক দেশে। অথচ এই দেশগুলোই মূলতঃ এই বয়স ভিত্তিক ‘ম্যাচিউরিটি’ তত্ত্বের প্রবক্তা। এসব দেশে ‘বালিকা মা’-দের ক্রমবর্ধমান আধিক্যই প্রমাণ করে যে এদের এই বেঁধে দেয়া বয়সের সাবালকত্ব বা নাবালকত্ব তত্ত্ব ড্রাইভিং লাইসেন্স বা ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য হলেও অন্ততঃ প্রজননে সক্ষমতার ক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বালক-বালিকাদের নাবালকত্ব বা সাবালকত্ব যে ‘কোন নির্দিষ্ট বয়স নির্ভর নয়’ এবং পুরুষের বিয়ের জন্য ‘দায়িত্বশীল বয়সে’ উপনীত হওয়া শর্ত হলেও নারীদের বিয়ের ক্ষেত্রে যে তা অবস্থার প্রেক্ষিতে শীথিলযোগ্য সেটাও বস্তুতঃ পরিষ্কার করা হয়েছে রসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক বালিকা আয়েশা (রাঃ)-কে বিয়ের মাধ্যমে। উল্লেখ্য যে ছয় বছর বয়সে বিয়ে হলেও হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে তুলে নেয়া হয়েছিল নয় বা দশ বছর বয়সে যা থেকে বোঝা যায় যে স্বামীর ঘরে নেয়া পর্যন্ত বালিকা বধূকে পর্যাপ্ত মানসিক স্থিরতার সুযোগ দেয়া অবশ্যক।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে হযরত আয়শা (রাঃ)-কে বালিকা বয়সে উম্মুল মু’মিনীন করার পেছনে শুধুমাত্র বালিকাদেরকে বিয়ে করার রীতি প্রতিষ্ঠা করাই আল্লাহ পাকের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। বরং রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পরও নবীজীর ব্যক্তি, পারিবারিক ও কর্ম জীবন সম্বন্ধে দীর্ঘকাল ব্যাপী যাতে কেউ একজন মানুষের অনুসন্ধিৎসার যথাযথ উত্তর দিতে পারে সেজন্যেও সম্ভবতঃ অনন্য মেধার অধিকারী অল্প বয়সী আয়শা (রাঃ)-কে রাখা হয়েছিল নবীজীর সবচেয়ে কাছে। আর সেই দায়িত্বটা যে হযরত আয়েশা (রাঃ) অতি দক্ষতার সাথেই পালন করেছিলেন তার প্রমাণ মেলে উনার সূত্রে বর্ণিত অগণিত হাদীস এবং সেসবের গুরুত্ব থেকে। আর তাই নবীজীর সাথে আয়েশা (রাঃ) বিয়েকে দুই, একটা সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার কোনই সুযোগ নেই।
এই বিশ্লেষণ থেকে বালিকাদের বিয়ের উদাহরণ পাওয়া গেলেও ছিদ্রান্বেষীদের প্রধান সমস্যা হলো বালিকাদের মা হওয়া নিয়ে, যা কিনা বৈজ্ঞানিক ভাবেও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত। কম বয়সে মেয়েরা মা হলে মা ও শিশু উভয়কেই অনেক ধরনের জটিলায় পড়তে হতে পারে। আমদের দুই-এক প্রজন্ম আগের সমাজেই ব্যপক ছিল তেমন বালিকা বিয়ের প্রথা। সে সময় ‘মিসক্যারেজে’র ঘটনাও ছিল নিত্যনৈমিত্তিক যা জানা যায় সমাজের বয়স্কদের কাছে থেকে। তাই এটা নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয় যে ইসলাম কি তাহলে বালিকাদের মা হওয়া প্রতিরোধ করতে চায় না? এক্ষেত্রে মোক্ষম জবাব হলো আল্লাহ পাক অনুমতি দিয়েছেন বালিকা বিয়ে করার এবং সে মতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বিয়েও করেছিলেন হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে, কিন্তু সেই বালিকা বধূকে তিনি কখনই কিন্তু কোন সন্তানের মা করেননি। উল্লেখ্য হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কোন সন্তানাদি ছিল না। অর্থাৎ ইসলামে বিয়ে মানেই ‘ভোগ’, ‘উপভোগ’ নয় বরং দায়িত্ব। যতটুকু ‘সুখের উপভোগ’ সেখানে বিদ্যমান সেটা মূলতঃ কঠিন দায়িত্ববোধেরই প্রতিফল বিশেষ। এই দায়িত্ববোধের আলোকেই বালিকা বধূকে মা না করাই যে উত্তম সেটাও উদাহরণসহ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে।
এরপরও যদি কোন মুসলমান কোরআন-হাদীসের দোহাই দিয়ে যেনতেন প্রকারে বালিকা বিয়ে করে তাকে বছর বছর সন্তানের মা হতে বাধ্য করে তাহলে ঐ স্বামীকে দোষী সাব্যস্ত করে সামাজিক ভাবে তার বিচার করাই বোধকরি যথার্থ হবে। কিন্তু সে পথে না গিয়ে ঐ সমস্ত ব্যক্তিগত ধান্ধাবাজীর জন্যেও ইসলামকে দোষারোপ করাটা খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ।
এখানে বিশেষ ভাবে আরও উল্লেখ্য যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে প্রায় দশ বছর সংসার করার পরও হযরত আয়েশা (রাঃ) কোন সন্তানাদি না হওয়ার দ্বারা এটাও প্রতিষ্ঠিত হয় যে দম্পতিদের অধিকার আছে নিজেদের প্রয়োজন মাফিক পরিকল্পনা করে সন্তান নেয়া বা না নেয়ার। তবে এজন্যে তাদেরকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে প্রাকৃতিক ‘জন্মনিয়ন্ত্রন’ পদ্ধতি। অতি প্রাকৃতিক তথা কৃত্রিম পদ্ধতির জন্মনিয়ন্ত্রন কার্যক্রম আমদের দেশ যে কি ভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর অনিবার্য সুদূরপ্রসারী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের সমাজের যে আজ কি বেহাল অবস্থা হয়েছে তা সাম্প্রতিক কালে পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সরকারি পরিসংখ্যানগুলোতেই স্পষ্ট। অথচ শুরু থেকেই যদি স্ত্রীদের স্বাভাবিক শরীরিক চক্র মেনে প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হতো তা হলে যেমন সাশ্রয় হতো অর্থ ও সময়ের তেমনি ফলাফল হতে পারতো আশানুপাতিক। সর্বোপরি সেটা একটা সহিষ্ণূ সমাজ গড়ার পথেও হতে পারতো খুবই সহায়ক।
[চার] দাসী কেন বধূ , ভাল লাগার স্বীকৃতি এবং নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে
আল্লাহর বিধানে বিয়ের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতাই মূখ্য। তারপরও রক্ত মাংসে গড়া মানুষের মনে বিবিধ আকাংখার সৃষ্টি হতে পারে। দায়িত্ববোধ ছাপিয়ে কখনও কখনও কামনা-বাসনাও প্রধান হয়ে উঠতে পারে। কর্মক্ষেত্রে, বিশেষতঃ পুরুষরা যেখানে নারীদের আইনানুগ কর্তা সেখানে দীর্ঘ জানাশোনা বা নিত্য একত্রে ওঠা বসার কারণে সৃষ্টি হতে পারে শারীরিক বা মানসিক চাহিদার। আবার বিয়ের ঝামেলা এড়াতে ছলে, বলে, কৌশলে অধঃস্তন নারীকে ভোগ করার পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে কি হবে উপায়? কি ভাবে ঠেকানো সম্ভব এই ধরনের অনাচার?
উল্লেখ্য যে এসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলে অবৈধ পন্থার বিকাশ হতে বাধ্য। যেখানে বিল ক্লিনটনের সম্মানিত সহকর্মী হওয়ার পরও রক্ষা পায়নি মনিকা সেখানে দাসী, ক্রীতদাসী, নারী গৃহকর্মী যারা পুরুষ মনিব বা মালিকের হয়ে কাজ করছে তাদের অবস্থা সহজেই অণুমেয়। এসব ক্ষেত্রে মানুষকে অবৈধ পন্থার দিকে পা বাড়ানো থেকে রক্ষা করতে দয়াময় আল্লাহ পাক বাতলে দিয়েছেন পথ। ঐ রকম পরিস্থিতিতে ইসলামের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়ে করে নেয়াটাকে করেছেন জায়েজ। পূর্ণ দায়িত্ব নেয়া সাপেক্ষে নিজের কর্তৃতাধীন ঐ সব নারীদেরকে তিনি হালাল করেছেন পুরুষদের জন্য (৪:৩,২৫; ২৩:৬)। এখানেও নারীর প্রতি ‘পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ববোধের’ ব্যবস্থাই মূখ্য। কোন ধরনের দায়িত্ব নেবো না, শুধুই ভোগ করবো এমন নারী-পুরুষের সম্পর্ক হলো ‘চূড়ান্ত অবিচার’ এবং ‘নারী জন্য চরম অপমানজনক’ যা আল্লাহর আইনে একেবারেই অসম্ভব।
বর্তমান সমাজে অতি সহজলভ্য অর্থের বিনিময়ে যে ‘নারী ভোগ’ সেখানে ‘ভোগের বিনিময় হিসেবে’ নারীকে যে টাকা-পয়সা প্রদান করা হয় সেটাকে কুযুক্তিবাদীরা ‘নারীর প্রতি দায়িত্ব পালন করা হলো’ বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এরকম শুধু্মাত্র ‘সুখ ভিত্তিক বিনিময়’ আর দুটি মানব জীবনের প্রতিদিনের চাওয়া-পাওয়া পরস্পর ভাগাভাগি নেয়ার যে চিরস্থায়ী ‘বিনিময়’ তা কখনই এক হবার নয়। আর তাই এই সমস্ত ধান্ধাবাজী যুক্তি দিয়ে ‘নারী কেনা-বেচা’ জায়েজ করার কোনই অবকাশ আল্লাহর আইনে নেই।
এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয় যে এই ধরণের অনিবার্য পরিস্থিতিতে নারী-পুরুষের মাঝে সৃষ্ট দেহ-মনের আশা বা আকাংখাকে আল্লাহ পাক কখনই গায়ের জোরে গলা টিপে হত্যা করেননি বরং তাকে স্বাভাবিক উপায়ে একটা সুন্দর পরিণতির দিকে যেতে পথ করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ পাকের এই বিধানের বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্যেই আল্লাহর নির্দেশ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বিয়ে করতে হয়েছিল তাঁর দাসী হযরত মারিয়া বা মারিয়াম (রাঃ)-কে। এতে এটাই স্পষ্ট হয় যে দুই জন নারী-পুরুষের দেহ-মনে সৃষ্ট আবেগ-অনুভূতিকে শক্তির দ্বারা রুখে দেয়া আল্লাহ পাকের নীতি বিরূদ্ধ। বরং নারী-পুরুষের মধ্যে এমন পরিস্থিতি যাতে শুরুতেই তৈরী হতে না পারে সেজন্যেই বস্তুতঃ ইসলামে পর্দার বিধান এত কঠোর। এমনকি পুরুষের মনে যাতে ‘কোন ধরনের ভাবের’ উদয় হওয়ার সুযোগই না হয় সেজন্যে আল্লাহ পাক নবীজীর স্ত্রীদের মাধ্যমে পরিবার বহির্ভূত পুরুষদের সাথে কথোপকথনেও বিশ্ব নারীকে কোমলতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছেন (৩৩:৩২)। একই ভাবে দেবরকে ভাবীর জন্য মৃত্যু তুল্য ঘোষণা করে রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিশ্চিত করেছেন যাতে সেখানে কোন অবস্থাতেই ভাবাবেগ তৈরী হওয়ার কোন পরিবেশই সৃষ্টি হতে না পারে (বোখারী)। অবশ্য ভাবীকে যদি কোন সময় হতে হয় মাতৃহীন শিশু দেবরের প্রতিপালক তবে সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে আল্লাহ পাকের ঐ আইন যেখানে তিনি নারীদেরকে এমন বালকদের সম্মুখে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন যাদের মধ্যে এখনও সৃষ্টি হয়নি কোন দেহজ অনুভূতি (২৪:৩১)। আবার বয়োঃপ্রাপ্তা নারীদের জন্যেও পর্দা শীথিল যোগ্য (২৪:৬০)।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিধানের মূল লক্ষ্যটাই হচ্ছে শুরু থেকেই এমন অবস্থার উদ্ভবই হতে না দেয়া যাতে নারী-পুরুষের মাঝে মনের দেয়া-নেয়া হয়ে যাবে অথচ কোন ভাবেই তাদের মিলন সম্ভবপর হবে না।
বোধকরি এই একই কারণে খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ককে ইসলাম স্বীকৃতি দেয়। কঠোর পর্দার বিধান এই শ্রেনীর ভাই-বোনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হওয়ায় এদের মধ্যে মন দেয়া-নেয়ার সম্ভবনা থাকে খুবই বেশী। তাই এদের মধ্য যদি বিয়ে হারাম করা হতো তাহলে এক্ষেত্রে অবৈধ পন্থার বিস্তার রোধ করা সম্ভব হতো না। আবার অনেক সময় অতি প্রয়োজনীয় পারিবারিক বা বৈষয়িক কারণেও অপরিহার্য হয়ে পড়ে এরকম বিয়ে। আর তাই ইসলাম কর্তৃক নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের স্বীকৃতি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার প্রয়োজনে খুবই বাস্তব সম্মত একটি পদক্ষেপ।
অথচ কেউ কেউ এই ধরনের পারিবারিক বিয়েকে ঘৃণার চোখে দেখেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এমন অনেককে জানি যারা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েকে ঘৃণা করলেও সমকামীতাকে আবার সমর্থন করেন দৃঢ় ভাবে! অথচ সমকামীতা হলো এমনই ঘৃণ্য এক পন্থা যার চর্চা পশু-পাখীদের মধ্যেও দেখা যায় না। অর্থাৎ যারা সমকামীতাকে সমর্থন করেন তারা মূলতঃ সব জেনেশুনেও মানুষকে পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গের চাইতেও নীচে নামিয়ে ছাড়েন। এই সহজ সত্যটাও যে কিভাবে কিছু কিছু মানুষের কাছে অসত্য-অবোধ্য হতে পারে তা বোঝা বড়ই মুশকিল।
এখানে আরও একটা দলের দেখা পাওয়া যায় যারা এই ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক ঠেকাতে সহসা হয়ে ওঠে নর পিশাচ। প্রয়োগ করে থাকে ‘অনার কিলিং’-এর মত পৈশাচিক পদ্ধতি। এরা মুসলমান তো নয়ই এমনকি মানুষও নয়। এরা স্রেফ কিলার। এরা নর ঘাতক। আল কোরআনের ঘোষণা মতে এরা বস্তুতঃ সমগ্র মানব জাতির হত্যাকারী কারণ এদের এইসব পশুত্ব সর্বস্ব বর্বরতা পৃথিবীর সব আইনেই অন্যায় ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত (৫:৩২)।
নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েকে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে সবচেয়ে বেশী বাঁধাগ্রস্থ করা হয় যে কারণে তা হলো এই ধরনের বিয়েতে যেহেতু একই পারিবারিক ধারার ‘দুই সেট জিনের’ সম্মিলন ঘটে তাই শারীরিক ও মানসিক ভাবে দুর্বল সন্তান জন্মানোর সম্ভবনা থাকে বেশী। কথাটার মধ্যে বৈজ্ঞানিক সত্য আছে বটে তবে সেটা যে কোন দম্পতির ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। বর-কনের মধ্যে দূরতম সম্পর্ক না থাকার পরও তাদের রক্তের গ্রুপ সাংঘর্ষিক হতে পারে। এমনকি বিয়ের আগে বর-কনের রক্ত পরীক্ষাও গ্যারান্টি দেয় না দূরারোগ্য ব্যধিহীন সন্তান লাভের। কারণ মা-বাবার দেহের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় থাকা জেনেটিক রোগ অজ্ঞাত কারণেও প্রকাশ হতে পারে কোন কোন সন্তানের মধ্যে। নিজ উম্মতের কাছে এই বিষয়টা স্বপ্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করতেই সম্ভবতঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর সময় নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই বিয়ে হয়েছে বেশী। তিনি নিজে যেমন এ ধরনের বিয়ে করেছেন তেমনি নিজের সন্তানদেরকেও বিয়ে দিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে।
[পাঁচ] পালক সন্তান বিষয়ে কুসংস্কারের মূলোৎপাটন
বিয়ের ক্ষেত্রে অন্য যে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার রসূলুল্লাহ (সাঃ) করেছেন তা হলো ‘রক্তের সম্পর্কের বিশুদ্ধ পরিচিতি’কে প্রতিষ্ঠিত ও নিশ্চিত করা। এটা করতে গিয়ে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বিয়ে করতে হয়েছিল নিজ পালক পূত্র হযরত যায়েদ (রাঃ)-এর পরিত্যক্তা স্ত্রীকে (৩৩:৩৭) যা কিনা এখনকার সমাজেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।
রক্তের সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম সত্যটা হলো যে এটা কখনই কোন ব্যক্তি বা সমাজের কথায় নির্ধারিত হওয়ার বিষয় নয়। তাই নিজের সন্তানের মত কোলে পিঠে মানুষ করার পরও পালক সন্তানকে কখনই আসল বিবেচনা করার কোন অবকাশ নেই। এখানে ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি মূল্যহীন। এক্ষেত্রে যদি এমন কঠোর নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করা না হত তাহলে সহায়-সম্পদের লোভে অনেকেই ছলে-বলে-কৌশলে এরকম পাতানো সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়াস পেত। এমনকি শুরু হতে পারত পাতান সম্পর্ক গড়ার ব্যবসা। এতে করে নিশ্চিত ভাবেই প্রকৃত রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন ও সন্তানদের ব্যপক ভাবে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হতো এবং পুরো সমাজ ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পরত এক সময়।
একই ভাবে রসূলুল্লাহ (সাঃ) –এর অন্য বিয়েগুলোরও প্রতিটির পেছনেই ছিল এমনই সব আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসমূহ। আরও ছিল মানুষের ভাবাবেগ ও কল্পনাপ্রসূত কালা-কানুনসমূহের সত্য দর্শন ভিত্তিক সুদূরপ্রসারী সংস্কারের উদ্দেশ্য যা তাঁকে বাস্তবে করে দেখাতে হয়েছিল। এত সব সামাজিক সংস্কার সফল ভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে নবীজী (সাঃ) এই সত্যটাও প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন যে এই বিশ্বের যে কোন জায়গায় যে কোন সমাজে যে কোন সময় যে কোন কোরআনিক আইনের সফল প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সম্ভব।
জীবনের প্রতিটি দিনের প্রতিটি কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রিয় নবীজী (সাঃ) আরও প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে মানুষের ঈমান যদি সত্যিকার অর্থেই একমাত্র সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে দৃঢ় ও বিশুদ্ধ ভাবে নিবেদিত হয় তাহলে যুদ্ধ-বিগ্রহ, দুঃখ-শোক, অভাব-অভিযোগ-দূর্ভিক্ষ এমনকি বহু স্ত্রী-সন্তানের ঘর-সংসারও তাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যূত করতে পারে না। সেজন্যেই তেরো জন স্ত্রী থাকার পরও নবীজীর নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত কাজা হওয়ার কোনই উদাহরণ নেই। তাই তাঁর উম্মতদের মধ্যে আল্লাহ যাদেরকে তৌফিক দেবেন একাধিক স্ত্রী এবং অনেক পূত্র, কন্যার অধিকারী হওয়ার তাদের জন্যেও কোনই উপায় বা অজুহাত নেই নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত বা জেহাদের মত অত্যাবশ্যক ইসলামী কাজ থেকে অবকাশ নেয়ার বা পাওয়ার।
মাত্র বাষোট্টি বছর আয়ুষ্কালের মধ্যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শেষ করতে হয়েছিল তাঁর বিশাল মিশন আর সে কারণেই তাঁর সর্বমোট পরিবারের সংখ্যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল তেরোতে। বলাই বাহুল্য বিশ্বের আর কাউকেই এমন দূরূহ মিশনে নামতে হবে না আর কখনই। তাই এক সাথে চার জনের বেশী স্ত্রী রাখারও আর কোন প্রয়োজন হবে না কারোরই। তবে যারা সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর খাঁটি বান্দা তারা যে কখনই অপ্রয়োজনে একের অধিক স্ত্রী রাখতে আগ্রহী হবেন না সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই কারণ আল্লাহ পাক খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে একের অধিক স্ত্রী নিতে চাইলে তাদের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ে স্বামীকে অবশ্যই সমতা রক্ষা করে চলতে হবে যা কিনা সাধারণ মানুষের পক্ষে দুরূহ, আর তাই মানুষের জন্যে এক স্ত্রীতে সন্তুষ্ট থাকাই উত্তম (৪:৩, ১২৯)।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সমস্ত জীবন, বিশেষতঃ তাঁর পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুরোটা সময়ই ছিল ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি’ তাই তাঁর বিয়েগুলোও ছিল সেই সময়ের বিশেষ বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতি স্বাপেক্ষ। আল্লাহ পাকের রসূল পদে অভিষিক্ত হওয়ার পরপরই নবীজীকে বহু সম্পদের লোভ দেখানো হয়েছে, প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল বড় বড় ঘরে ভাল ভাল অসংখ্য বিয়েরও, শুধু শর্ত ছিল আল্লাহর দ্বীন থেকে সড়ে আসার। সেইসব প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অকাতরে। এসব তথ্য লিখিত দলিল আকারে এখনও বর্তমান ইতিহাসের পাতায়। রসূল পাকের ছিদ্রান্বেষীদের মত অনুযায়ী তিনি যদি সত্যিই তাঁর শারীরিক চাহিদা মেটাতেই দশের অধিক বিয়ে করে থাকেন তা হলে তিনি তা বহু আগেই করতে পারতেন, পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোন দরকার ছিল না।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে মানুষের জীবন ও সমাজকে বিচিত্র সব কল্পনা মিশ্রিত কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে এই বিশ্বে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বেঁচে থাকাটাকে মানুষের জন্য সহজ, সাবলিল, সম্মানজনক এবং অর্থপূর্ণ করতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) একক ভাবে যে অবিশ্বাস্য ও অসামান্য অবদান রেখেছেন তার কারণেই তিনি হতে পেরেছেন ‘রাহমাতুল্লিল আল-আমিন’ তথা ‘জগতসমূহের জন্য রহমত’ (২১:১০৭)। স্বয়ং আল্লাহ পাকের কাছ থেকে এমন স্বীকৃতি পাওয়া কোন সহজ সাধ্য বিষয় নয়।
সুতরাং সময়, কাল, অবস্থা এবং মিশনকে আমলে না নিয়ে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যক্তি জীবন, কর্ম জীবন বা তাঁর তেরো বিয়ে নিয়ে কথা বলা এবং সেই সব খন্ডিত ও অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণ সমূহের ভিত্তিতে আজকের সুবিধাজনক সময়ে বসে আল্লাহ পাকের সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহের যেনতেন ব্যাখা করার চেষ্টা করাটা হবে ভয়ানক অন্যায় এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
লস এঞ্জেলস, ইউএসএ

শপথ ভঙ্গকারীর কাফফারার বিধান

শপথ ভঙ্গকারীর কাফফারার বিধান


৮৭. ইয়া-আইয়্যুহাল্লাযীনা আ-মানূ লা তুহার্রিমূ ত্বায়্যিবা-তি মা আহাল্লাল্লা-হু লাকুম্ ওয়া লা-তা'তাদূ; ইন্নাল্লা-হা লা-ইউহিব্বুল মু'তাদীন।
৮৮. ওয়া কুলূ মিম্মা রাযাক্বাকুমুল্লা-হু হালা-লান ত্বায়্যিবা; ওয়াত্তাক্বুল্লা-হাল্লাযী আনতুম বিহি মু'মিনূন।

৮৯. লা-ইউআ-খিযুকুমুল্লা-হু বিল্লাগওয়ি ফী আইমা-নিকুম ওয়া লা-কিন ওয়া-খিযুকুম্ বিমা- আক্বাদ্তুমুল আইমা-না; ফাকাফ্া-রাতুহূ ইত্বআ'-মু আ'শারাতি মাছাকীনা মিন্ আওছাতি্ব মা তুত্বয়ি'মূনা আহ্লীকুম্ আও কিছওয়াতুহুম আও তাহ্রীরু রাক্বাবাহ; ফামান লামইয়াজিদ ফাসিইয়ামু ছালা-ছাতি আইয়্যামিন; যা-লিকা কাফ্ফা-রাতু আইমা-নিকুম ইযা হালাফ্তুম; ওয়াহ্ফাযু আইমা-নাকুম; কাযা-লিকা ইউবায়্যিনুল্লা-হু লাকুম আয়াতিহী লাআ'ল্লাকুম তাশ্কুরূন।
[সুরা : আল মায়েদা, আয়াত : ৮৭-৮৯]
অনুবাদ
৮৭ হে ইমানদাররা, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য যেসব পবিত্র জিনিস হালাল করে দিয়েছেন, তোমরা সেগুলো নিজেদের জন্য হারাম করে নিয়ো না। আর কখনো সীমালংঘন করো না, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সীমালংঘনকারীদের অপছন্দ করেন।
৮৮. আল্লাহ তায়ালা তোমাদের যে হালাল ও পবিত্র রেজেক দান করেছেন তোমরা তা খাও এবং আল্লাহর প্রতি দায়িত্বনিষ্ঠ থাকো, যার ওপর তোমরা ইমান এনেছ।
৮৯. আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য পাকড়াও করবেন না। কিন্তু পাকড়াও করবেন সেসব শপথের বেলায়, যেগুলো তোমরা জেনে বুঝে ভবিষ্যতের বিষয়ের ব্যাপারে করো। (এরূপ শপথ ভঙ্গ করা হলে) এর কাফফারা হলো, ১০ জন গরিব মিসকিনকে মধ্যম মানের খাবার খাওয়ানো, যা তোমরা সাধারণত তোমাদের পরিবার-পরিজনকে খাইয়ে থাকো। কিংবা তাদের (মধ্যম মানের) পরিধেয় বস্ত্র দান করা, অথবা একজন ক্রীতদাস বা দাসী মুক্ত করে দেওয়া। যে ব্যক্তি এর কোনোটাই পারবে না তার জন্য তিন দিন রোজা রাখা। শপথ ভাঙলে এ হলো কাফফারা। তোমরা তোমাদের শপথগুলো রক্ষা করো। আল্লাহ তায়ালা এভাবেই তার আয়াতগুলো তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারো।
ব্যাখ্যা
৮৭ নম্বর আয়াতটির শানে নুজুল এ রকম : একদিন রাসুল (সা.) কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা বর্ণনা করছিলেন। এ সব বর্ণনা শুনে হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত আলী (রা.) প্রমুখ প্রধান প্রধান সাহাবি সংসার বর্জন করে কেবল আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকার শপথ করে বসলেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতটি নাজিল হয়। এখানে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে মধ্যপন্থী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। মানুষের জন্য দুনিয়াতে যেসব ভোগের সামগ্রী আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন সেগুলো ভোগ করাই স্বাভাবিক এবং আল্লাহর ইচ্ছাও তা-ই। জীবনের স্বাভাবিকতাকে পরিহার করা বা আল্লাহ যা হালাল করে দিয়েছেন তা হারাম করা উচিত নয়। আল্লাহ তায়ালা বৈরাগ্য চান না এবং অস্বাভাবিকতাও পছন্দ করেন না। বৈরাগ্য বা এ ধরনের প্রবণতাগুলোকেও আল্লাহ তায়ালা সীমালঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ ধরনের সীমালঙ্ঘনকারীদেরও আল্লাহ পছন্দ করেন না।
৮৮ নম্বর আয়াতেও আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় একই বিষয়বস্তুকে আরো খোলাসা করে বলা হয়েছে। মানুষের কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর প্রতি দায়িত্বনিষ্ঠ থাকা, তাঁর প্রতি জবাবদিহি করার কথা মনে রাখা। আর এ জন্য জীবনকে স্বাভাবিকভাবে ভোগ করা।
৮৯ নম্বর আয়াতে 'কসম খাওয়া' বা আত্মগত শপথ গ্রহণের ব্যাপারে বিস্তারিত বিধি-বিধান দেওয়া হয়েছে। প্রথম বিষয় হলো, সব শপথ বা কসমই সমান নয়। যে কসম অর্থহীন বা সে কসমের মধ্য দিয়ে কোনো বাস্তব কর্তব্য বর্তায় না, সেরকম কসম ধর্তব্য নয় অথবা এর কোনো কাফফারা নেই। কসম তিন প্রকার। (১) 'লাগব'-অর্থাৎ যে ধারায় কসম করা হয়েছে তা বাস্তব নয়। এ ধরনের কসমের কোনো দণ্ড নেই। (২) গামুস-অর্থাৎ অতীতের যে কাজটি মিথ্যা, সেটাকে সত্য বলে কসম করা। এর শাস্তি শুধু তওবা। (৩) মুন আক্বেদাহ-অর্থাৎ ভবিষ্যতের কোনো কাজ করার বা না করার ইচ্ছাকে দৃঢ় করার জন্য কসম করা। এ ধরনের কসম ভঙ্গ করলে কাফফারা ওয়াজিব হবে। এর কাফফারা কী, তা এই আয়াতে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।

মাংস হালাল-হারাম হওয়ার ব্যাপারে কতিপয় বিধিবিধান

মাংস হালাল-হারাম হওয়ার ব্যাপারে কতিপয় বিধিবিধান

Maolana.Hoshen.Ali's picture

৩. হুর্রিমাত 'আলাইকুমুল মাইতাতু ওয়াদ্দামু ওয়া লাহ্মুল খিন্যীরি ওয়া মা উহিল্লা লিগাইরিল্লাহি বিহি ওয়াল মুন্খানিক্বাতু ওয়াল মাওক্বূযাতু ওয়াল মুতারাদ্দিইয়াতু ওয়ান্নাত্বীহাতু ওয়া মা আকালাস সাবু'উ ইল্লা মা যাক্কাইতুম; ওয়া মা যুবিহা 'আলান নুসুবি ওয়া আন তাস্তাক্বসিমূ বিল আঝ্লামি; যালিকুম ফিস্ক্বুন; আল-ইয়াওমা ইয়ায়িসাল্লাযীনা কাফারূ মিন দীনিকুম ফালা তাখ্শাওহুম ওয়াখ্শাওনি; আল-ইয়াওমা আক্মাল্তু লাকুম দীনাকুম ওয়া আত্মাম্তু 'আলাইকুম নি'মাতী ওয়া রাদ্বীতু লাকুমুল ইসলামা দীনা। ফামানিদ্ব্তুর্রা ফী মাখ্মাসাতিন গাইরা মুতাজানিফিল লি-ইছ্মিন ফাইন্নাল্লাহা গাফূরুর রাহীম। [সুরা : আল-মায়িদা, আয়াত : ৩]

অনুবাদ : ৩. তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের মাংস এবং যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই করা হয়েছে। এ ছাড়া শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরা, আঘাত পেয়ে মরা, ওপর থেকে পড়ে মরা, শিংয়ের আঘাতে মরা এবং হিংস্র জন্তুর খাওয়া প্রাণী_এগুলোও হারাম। তবে তোমরা যদি তা জীবিত অবস্থায় পেয়ে জবাই করে থাকো, তাহলে ভিন্নকথা। পূজার বেদিতে বলি দেওয়া জন্তু হারাম, জুয়ার তীর নিক্ষেপ করে ভাগ্যনির্ণয় করা জন্তু হারাম_এসবই বড় গুনাহ্র কাজ। এখন কাফিররা তোমাদের ধর্মের মূলোৎপাটন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েছে। সুতরাং তাদের ভয় করো না, বরং আমাকেই (আল্লাহকেই) ভয় করো। আজ আমি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকেই আমি ধর্ম হিসেবে পছন্দ করে নিলাম। যদি কোনো ব্যক্তি ক্ষুধার তাড়নায় হালাল নয় এমন খাদ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু সে কোনো পাপের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায় না, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

ব্যাখ্যা : এই আয়াতের মাধ্যমে খাদ্যে হালাল-হারাম সম্পর্কিত কিছু বিধিবিধান জারি করা হয়েছে। শুরুতেই চার ধরনের বস্তুকে হারাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের মাংস এবং আল্লাহর নামে জবাই করা হয়নি এমন জন্তু। মুসলিম ব্যক্তি যখন কোনো জন্তু জবাই করে, তখন আল্লাহর নাম স্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করলেও তা আল্লাহর নামে জবাই করা হয়েছে বলেই বিবেচিত হবে। কারণ, মুসলমানদের অন্তরে আল্লাহ আছেন। এরপর আরো কয়েক ধরনের বস্তুকে হারাম হিসেবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে যাওয়া কোনো প্রাণী, আঘাত পেয়ে মারা যাওয়া কোনো প্রাণী, ওপর থেকে পড়ে মারা যাওয়া কোনো প্রাণী, শিংয়ের আঘাতে মারা যাওয়া প্রাণী এবং হিংস্র জন্তুর শিকার করা ও আংশিক খেয়ে ফেলা কোনো প্রাণী। এ ধরনের মরা কোনো প্রাণী এবং সর্বোপরি মরা কোনো প্রাণী হারাম। তবে উপরোক্ত অবস্থায় নিপতিত হয়ে যে প্রাণীটি মারা যায়নি, বরং জীবিত অবস্থায় একে জবাই করা গেছে, সেটা হালাল হবে। এ ছাড়া পূজার বেদিতে বলি দেওয়া জন্তু হারাম এবং জুয়ার তীর নিক্ষেপ করে ভাগ্যনির্ণয় করা জন্তু হারাম। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রাক-ইসলাম যুগে পশু জবাইসংক্রান্ত একটি খেলা প্রচলিত ছিল। তা হলো_কয়েকজন মিলে একটি পশু কিনে জবাই করত, তবে প্রত্যেকের দেওয়া টাকা অনুযায়ী মাংস বণ্টন করা হতো না। ১০টি তীর নিয়ে সাতটিতে পরিমাণ চিহ্ন এঁকে দেওয়া হতো এবং তিনটি খালি রাখা হতো। অতঃপর প্রত্যেকের নামে একেকটি তীর থলে থেকে উঠানো হতো। ওই তীরে যে পরিমাণ চিহ্নিত থাকত, তাকে সেই পরিমাণ মাংস দেওয়া হতো। যার নামে চিহ্নবিহীন তীর উঠত, সে কিছুই পেত না। আলোচ্য আয়াতে এ ধরনের জুয়া খেলা এবং সেই পশুর মাংস হারাম করা হয়েছে।

'আল-ইয়াওমা আকমাল্তু লাকুম...' আয়াতটি নাজিল হয়েছে হিজরি দশম সনের ৯ জিলহজ বিদায় হজের দিন। এরপর রাসুল (সা.) মাত্র তিন মাস বেঁচে ছিলেন। 'ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম'-এর অর্থ জীবনের সব সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়ে গেছে, এমন নয়। এর অর্থ, ধর্মের বিধান নাজিল সমাপ্ত হতে যাচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ খবরটি দেওয়ার পর খাদ্যের ব্যাপারে আরো কিছু কথা বলা হয়েছে।

Friday, May 30, 2014

ডাউনলোড

ডাউনলোড


বুলুগুল মারাম


বুলুগুল মারাম
তাহক্বীক্ব বুলুগুল মারাম মিন আদিল্লাতিল আহকাম বইটির লেখক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)। এটি বিশ্বব্যাপী বহুল পরিচিত একটি কিতাব যাতে মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় সকল ফিকহ ই বিষয় হাদিসের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটি সবার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। বইটির সূচীপত্র সকলে সুবিধার জন্য ইন্টারলিংক্‌ড করা হয়েছে। নিজে পড়ুন এবং অন্যদের...
বাকি অংশ»

বাংলা হাদীছ সফটওয়্যার


বাংলা হাদীছ সফটওয়্যার
‘Digital Bangla Hadith Team’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থ থেকে বাংলা ইউনিকোড ফন্টে হাদীছ টাইপ করে কম্পিউটারে সহজে পড়ার উপযোগী করে আরবী, বাংলা ও ইংরেজী অনুবাদসহ একটি হাদীছ সফটওয়্যার তৈরি করেছে। আপনার সংগ্রহে না থাকলে এখান থেকে বিনামূল্যে ডাউনলোড করে নিন। বর্তমান ভার্সনে আছে: Sahih Bukhari (Complete) Sahih...
বাকি অংশ»

কুরআনের তেলাওাত সহ বাংলা অনুবাদ:অডিও


কুরআনের তেলাওাত সহ বাংলা অনুবাদ:অডিও
সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ কুরআনে কারিমের সহজ সরল বাংলা অনুবাদের এই সিডিটি আপনাদের জন্য পেশ করেছে কুরআনের আলো পাবলিকেশন্স। এই সিডিতে কুরআন তেলাওয়াত করেছেন মক্কায় অবস্থিত মাসজীদ আল হারাম এর ইমাম, শেইখ সাউদ আস সুরাইম । বাংলা অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশন। এবং বাংলা অনুবাদে কন্ঠ দিয়েছেন জায়েদ ইকবাল। সব ফাইল একসাথে ডাউনলোড করুন zip (916...
বাকি অংশ»

ডাউনলোড:বিভিন্ন বিষয়ের উপর ৪০০ লেকচার।


ডাউনলোড:বিভিন্ন বিষয়ের উপর ৪০০ লেকচার।
download link: http://www.mediafire.com/?933d3yte9900t
বাকি অংশ»

কুরআন কি আল্লাহর বানী? ইসলাম বিদ্বেষীদের দাতভাঙ্গা জবাব!


কুরআন কি আল্লাহর বানী? ইসলাম বিদ্বেষীদের দাতভাঙ্গা জবাব!
কুরআন কি আল্লাহর বানী? Is the Quran God’s words? Duration:03:14:20 MP3 Size:88.9mb Download link: Mediafire: http://www.mediafire.com/?ldu4ldlbw44k0c4 Ziddu: http://www.ziddu.com/download/22212911/QurankiAllahorbani--www.banglainternet.com.mp3 RELATED VIDEO:
বাকি অংশ»

হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ


হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ
হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ -Bangla Islamic song
বাকি অংশ»

খালিদ হোসেন – ইসলামী নজরুল গীতি-সাহারাতে ফুটলো রে ফুল


খালিদ হোসেন – ইসলামী নজরুল গীতি-সাহারাতে ফুটলো রে ফুল
খালিদ হোসেন, গত পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ নজরুল গীতির ধারক, বাহক, শিক্ষক। বিশুদ্ধ ও মূল সুরে নজরুল গীতি গায়ন ও শিক্ষাদানে তিনি একজন দিকপাল। তাঁর নজরুল গীতির রেকর্ড অতীতে এইচ এম ভি ও ঢাকা রেকর্ডস থেকে বের হয়েছে। তিনি বিভিন্ন সময়ে, নজরুল অ্যাকাডেমি, নজরুল ইন্সিটিউট, হিন্দোল এ কর্মরত থেকে নজরুল সঙ্গীতের প্রসারে ব্যাপক অবদান...
বাকি অংশ»

হজ্জ,উমরাহ ও যিয়ারত


হজ্জ,উমরাহ ও যিয়ারত
ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ্জ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদাত। এই বইটিতে হজ্জ ও উমরাহ্‌র আমরা কিভাবে সুন্দর ও সঠিক ভাবে সম্পাদন করতে পারি তা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও সাবলীলভাবে আলোচনা করা হয়েছে। লিখেছেনঃ শেইখ আবদুল্লাহ আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায | পৃষ্ঠাঃ ১৫৭ Download/ডাউনলোড http://server1.quraneralo.com/book/Hajj_O_Umrah.pdf
বাকি অংশ»

বদনজর, জাদু ও জিনের চিকিৎসা


বদনজর, জাদু ও জিনের চিকিৎসা
বর্তমানে বদনজর, জাদু ও জিনের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ধরণের শিরকি ঝাড়ফুকঁ ও তাবিজের ব্যবসা করছে অনেকে। আর এর দ্বারা মানুষের ঈমান ও অর্থ লুটে নিচ্ছে এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ীরা। এদের খপ্পড় থেকে বাঁচার জন্য “বদনজর, জাদু ও জিনের চিকিৎসা” বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের অলোকে আমাদের এ ছোট প্রয়াস। আশা করি এ থেকে সাধারণ...
বাকি অংশ»

সহীহ বুখারী (১ম-৬ষ্ঠ খণ্ড) ডাউনলোড


সহীহ বুখারী (১ম-৬ষ্ঠ খণ্ড) ডাউনলোড
যে সকল ভাই এই বইগুলো স্ক্যান করে ইন্টারনেট জগতে ছড়িয়ে দিতে সময় ও শ্রম দিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে আমাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন আল্লাহ তায়ালা তাদের সবাইকে দুনিয়া ও আখেরাতে এর উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন। সহীহ বুখারী ১ম খণ্ড (২৮ মেগাবাইট) link: http://www.mediafire.com/download/krwol8pugcuhu77/Shahihul_Bukhari_Part_1.pdf সহীহ বুখারী (২য় খণ্ড) (৩০ মেগাবাইট) http://www.mediafire.com/download/krwol8pugcuhu77/Shahihul_Bukhari_Part_1.pdf সহীহ বুখারী (৩য়...
বাকি অংশ»

ইমাম ও ইমামতি-পর্ব (৩)

ইমাম ও ইমামতি-পর্ব (৩)

ইমাম ও ইমামতি-পর্ব (৩)
আব্দুর রাকীব মাদানী
নামাযের পূর্বে ইমামের করণীয়ঃ
১-আযানের পর কিছুক্ষণ বিরতি প্রদানঃ
আযানের পর এবং নামায শুরু করার পূর্বে ইমাম কতক্ষণ বিরতি দিবেন বা অপেক্ষা করবেন, তার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা সহী হাদীস দ্বারা বর্ণিত নয়। তবে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে কিছুক্ষণ বিরতি দেওয়া প্রমাণিত। কারণ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘প্রত্যেক দুই আযানের মাঝে নামায রয়েছে’’। [বুখারী,নং ৫৮৮] অর্থাৎ আযান ও ইকামতের মাঝে নফল নামায আছে। এমনকি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাগরিবের ফরয নামাযের পূর্বেও নামায পড়ার আদেশ দেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘তোমরা মাগরিবের পূর্বে নামায পড়, তোমরা মাগরিবের পূর্বে নামায পড়, তৃতীয়বারে বলেনঃ যার ইচ্ছা।” [বুখারী নং ১১৮৩]
তাছাড়া আযানের উদ্দেশ্যই হল, লোকদের সংবাদ দেওয়া যে নামাযের সময় হয়ে গেছে, যাতে করে তারা অযু করে নামাযের প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হয়। তাই আযানের পর সময় না দিলে এই মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট নয়।
ইশার নামায সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদি মসজিদে লোকদের অধিক হারে উপস্থিতি দেখতেন, তাহলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটু আগেই নামায শুরু করতেন আর যদি সংখ্যা কম দেখতেন তো একটু বিলম্ব করতেন। [বুখারী, নং ৫৬৫]
উপরোক্ত তথ্যানুসারে এটা স্পষ্ট যে, আযান ও ইকামতের মাঝে কিছুক্ষণ সময় অপেক্ষা করা প্রমাণিত ও মুস্তাহাব। তবে নির্দিষ্টরূপে এর সময়সীমা কতখানি হবে তা বর্ণিত নয়। তাই বিভিন্ন নামাযের পূর্বে সুন্নতে রাতেবার দিকে লক্ষ্য রেখে, নামাযীদের দুর কিংবা নিকটে অবস্থানের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং আরো অন্যান্য বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে ইমাম সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারেন। অনুরূপ ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ের সম্মতিতে যদি কোন সময় সুচী নির্ধারণ করা হয়, কিংবা সরকার বা মসজিদ কমিটির পক্ষ্য থেকে সময়সূচী নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যা সকলকে এক সাথে জামাআতের সাথে নামায আদায় করতে সহায়ক, তাহলে এই রকম করা অনুচিৎ নয়। তবে তাদের অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার যে, বিরতি যেন এত দীর্ঘ না হয় যাতে আউয়াল ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আশংকা থাকে কিংবা এত কম না হয় যাতে লোকদের মসজিদে আসা ও সুন্নত পড়া বাধাগ্রস্থ হয়।
২-সুতরা না থাকলে সুতরা করে নেওয়াঃ
সুতরা উঁচু বিশিষ্ট এমন বস্তুকে বলে যা নামাযী তার সাজদার স্থানের সম্মুখে রাখে, যেন কেউ তার ভিতর দিয়ে অতিক্রম না করে এবং এর বাইরে যা কিছু ঘটে সেই দিকে নামাযীর ধ্যান না যায়।
দেয়াল, প্রাচির, বেড়া, খুঁটি, লাঠি, বর্শা, বল্লম, গাছ, পাথর, বাহন (গাড়ি-ঘোড়া) ইত্যাদি লম্বা কিংবা চওড়া বিশিষ্ট বস্তু সুতরার জন্য প্রযোজ্য। [মুগনী,৩/৮০, আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিকহী,৭২-৭৩]
ইমাম যখন তাঁর মিহরাবে (ইমাম দাঁড়ানোর স্থান) দেয়ালের নিকটে নামায পড়াবে তখন সেই দেয়াল তার সুতরা হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন আর অন্য ভিন্ন সুতরা মেহরাবে রাখার প্রয়োজন নেই। তাই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মিহরাবে সুতরা থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ইমাম যদি মসজিদের মাঝে নামায পড়ায় কিংবা ফাঁকা স্থানে নামায পড়ায় অর্থাৎ সামনের স্থান খালি থাকে, কারো অতিক্রম করার আশংকা থাক কিংবা না থাক, তাহলে সামনে সুতরা রাখা মুস্তাহাব। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
” إذا صلّى أحدكم، فليُصلّ إلى سُترة، وليدْنُ منها”
“তোমাদের কেউ যখন নামায পড়বে, তখন যেন সে সুতরা সামনে করে নামায পড়ে এবং তার নিকটবর্তী হয়”। [আবু দাঊদ, নং ৬৯৮, ইবনু মাজাহ নং ৯৫৪, ইবনু খুযায়মাহ নং ৮৪১, সূত্র হাসান]
উপরোক্ত বিধানটি ইমাম ও একাকী নামাযী উভয়ের জন্য প্রযোজ্য তবে ইমাম সুতরা করলে আর মুক্তাদীদের সুতরা করার প্রয়োজন নেই, এটাই অধিকাংশ বিদ্বানের মত। [মুগনী,৩/৮১]
সুতরার দৈর্ঘতা এক বিঘত কিংবা এক গজ হওয়া এবং নামাযীর সাজদা ও সুতরার মাঝে একটি ছাগল পার হওয়ার মত ফাঁকা থাকা প্রমাণিত। [মুসলিম, অধ্যায়, সালাত,অনুচ্ছেদ, মুসল্লীর সুতরা,নং ১১১২, ১১১৪,১১৩৪/বুখারী নং ৪৯৪]
প্রকাশ থাকে যে, কিছু উলামা সুতরা করাকে ওয়াজিব বলেছেন, অনেকে সুন্নতে মুআক্কাদাও বলেছেন, তবে জমহূরে উলামা সুতরা করাকে মুস্তাহাব বলেছেন। পারত পক্ষে এই বিধান পরিত্যাগ করা উচিৎ নয়।
৩-লাইন সোজা করার আদেশ প্রদানঃ
নামাযে দাঁড়ানোর সময় লাইন সোজা করা, বরাবর হওয়া, লাইনের মাঝে জায়গা ফাঁকা না রাখা এবং প্রথম লাইন পূর্ণ করার পূর্বে দ্বিতীয় লাইন তৈরি না করা ওয়াজিব আমলের অন্তর্ভুক্ত। এটি যেমন মুক্তাদীদের কর্তব্য তেমন ইমামেরও দায়িত্ব যে, সে নামায শুরু করার পূর্বে এর আদেশ করবে এবং যথাসম্ভব নিজে তা পর্যবেক্ষণ করবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায শুরু করার পূর্বে বলতেনঃ
سوّوا صفُوفكم فإن تسوية الصف من تمام الصلاة” رواه البخاري و مسلم”
“তোমরা তোমাদের লাইন সোজা করে নাও কারণ লাইন সোজা করা নামাযের পরিপূর্ণতার অন্তর্ভুক্ত” [বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান, নং ৭২৩/ মুসলিম, অধ্যায়ঃ স্বালাত, নং ৯৭৪]
আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তকবীরে তাহরীমা দেয়ার পূর্বে আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন এবং বলতেন তোমরা একে অপরের সাথে ঘেষে দাঁড়াও এবং সোজা হয়ে দাঁড়াও” [বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান, নং ৭১৯/মুসলিম অধ্যায়ঃ নামায নং ৯৭৫]
৪-ইমামতির সময় ইমামের অবস্থানঃ
  • ক-ইমামতির সময় ইমাম মুক্তাদীদের তুলনায় উঁচু স্থানে অবস্থান করবে না। ইবনে মাসঊদ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইমামের কোন কিছুর উপরে অবস্থান করা আর মুক্তাদীদের তার থেকে নিম্ন স্থানে অবস্থান করা থেকে নিষেধ করেছেন।”।[দারা কুত্বনী, জানাযা অধ্যায়] তবে নামাযের নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে ইমামের উঁচু স্থানে ইমামতি করা বৈধ। [বুখারী, মাসাজিদ অধ্যায়ঃ নং৯১৭]
  • খ-ইমামের সাথে যদি এক পুরুষ ব্যক্তি নামায পড়ে তাহলে সে ইমামের ডান দিকে দাঁড়াবে। যদি ভুল করে সে তার বাম পার্শে দাঁড়ায়, তাহলে ইমাম তাকে তার ডান পার্শে করে নিবে। আর ইমামের সাথে যদি দুই কিংবা দুইয়ের অধিক পুরুষ ব্যক্তি শুরু থেকে নামায পড়ার জন্য উপস্থিত থাকে, তাহলে ইমাম আগে বেড়ে নামায পড়াবে আর তারা পিছনে এক লাইনে দাঁড়াবে। যদি ইমামের সাথে এক ব্যক্তি নামায পড়তেছে এমতাবস্থায় দ্বিতীয় ব্যক্তি শরীক হতে চায়, তাহলে মুক্তাদী দুজন পিছনে চলে আসবে আর ইমাম নিজ স্থানে থেকে ইমামতি করবে। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি ইমামের বাম পার্শে গিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ইমাম তাদের দুই জনকে পিছনে করে দিবে।  যদি ইমামের সাথে পুরুষ, মহিলা ও নাবালেগ বাচ্চা নামায পড়ে, তাহলে পুরুষেরা ইমামের পিছনে লাইন করবে অতঃপর পুরুষ বাচ্চারা লাইন করবে অতঃপর মহিলারা। যদি ইমামের সাথে একজন পুরুষ ও এক বা একাধিক মহিলা নামায পড়তে চায়, তাহলে পুরুষ ব্যক্তি ইমামেন ডান পার্শে দাঁড়াবে আর এক বা একাধিক মহিলা পিছনে আলাদা লাইনে দাঁড়াবে। [দেখুন নায়লুল আউত্বার, শাওকানী, অধ্যায়ঃ ইমাম ও মুক্তাদীদের অবস্থান..অনুচ্ছেদ নং ২১০, ৩/২২৬-২২৯]
  • গ-সকল নাবালেগ বাচ্চাদের এক লাইনে দাঁড় করালে যদি তাদের গোলমাল করার এবং বড়দের নামাযে বিঘ্ন ঘটার আশংকা থাকে, তাহলে বড়রা বাচ্চাদের মাঝে মাঝে নিয়ে নামায পড়তে পারে। [শারহুল্ মুমতি, ইবনু উসাইমীন,৪/২৭৮]
৫-ইমাম মুসাফির হলে নামাযীদের বলে দেওয়া, যেন তারা নামায পূরণ করে নেনঃ
মুসাফির ইমামের পিছনে মুকীম নামায পড়লে, ইমামের সালামের পর নামায পূরণ করতে হবে। এই সময় মুসাফির ইমাম সালাম ফিরানোর পর বলবেঃ আপনারা নামায পূরণ করে নিন কারণ আমি মুসাফির। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের সময় মক্কাবাসীদের ইমামতিকালে এইরূপ বলতেন। [আবু দাঊদ, সফর অধ্যায়, নং (১২২৯) মুআত্বা,২/২০৬] এই কথাটি নামাযের পূর্বেও বলা যেতে পারে। [মাজমুঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাঈল, ইবনে উসাইমীন/১৫/১৫৩]
নামাযরত অবস্থায় ইমামের করণীয়ঃ            
১-নামাযের রুকন ও ওয়াজিব কাজসমূহ পূর্ণরূপে সম্পাদন করাঃ
নামায পড়ানোর সময় ইমামের সবচেয়ে বড় করণীয় হচ্ছে, নামাযের রূকনগুলি ও ওয়াজিবগুলি পূর্ণরূপে ধীর-স্থিরতার সাথে সম্পাদন করা।কিয়াম, কুঊদ, রুকূ, সাজদা, রুকূ থেকে উঠা, দুই সাজদার মাঝে বসা ইত্যাদি কাজগুলি এমন ভাবে সম্পাদন করা যেন একটি কাজ শেষ হওয়ার আগে অপরটি শুরু না করা হয়। যেমন রূকূ থেকে উঠে ভালভাবে সোজা না হয়েই সাজদা করা। অনুরূপ এক সাজদা থেকে উঠে ভাল করে না বসেই দ্বিতীয় সাজদা করা। ফুকাহাগণ স্থিরতার সংজ্ঞায় বলেছেনঃ একটি কাজ করার সময় মানুষের অঙ্গের যেই নড়া-চড়ার প্রয়োজন হয় তা স্থির হওয়ার পর এতখানি স্থির থাকা যাতে ভালবাবে একবার তাসবীহ [সুবহানাল্লাহ] বলা সম্ভব হয়। উলামাগণের নিকট এই বিষয়টি ‘তা’দীলুল আরকান’ নামে পরিচিত, যা করা ওয়াজিব। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাড়াহুড়া করে নামায পাঠকারীকে পুনরায় নামায পড়ার আদেশ দেন। [বুখারী,নং ৭৯৩/ মুসলিম]
২-মুক্তাদীদের অবস্থার খেয়াল রাখাঃ
ইমামতির সময় ইমামকে খেয়াল রাখা উচিৎ যে, তার পিছনে মুক্তাদীদের অবস্থা একরকম নয়; বরং কেউ দুর্বল, কেউ অসুস্থ, কেউ বয়স্ক, কেউ প্রয়োজনীয় কাজের সাথে জড়িত এমনকি অনেক মায়ের সাথে তাদের ছোট সন্তানও থাকে। তাই লম্বা সূরা দ্বারা এবং যতটুকু যথেষ্ট তার অতিরিক্ত দুআ ও যিকির দ্বারা নামায দীর্ঘ না করা। একদা এক সাহাবী লম্বা সূরা দ্বারা নামায পড়ালে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ‘সাব্বিহিস্মা রাব্বিকাল্ আ’লা, ওয়াশ্ শাম্ সি ওয়া যুহাহা’ দ্বারা নামায পড়াতে আদেশ করেন। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৭০৫] নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
” إذا صلّى أحدكم للناس فليُخفف، فإن منهم الضعيف والسقيم والكبير. و إذا صلّى أحدكم لنفسه فليطول ما شاء ” -رواه البخاري
“যখন তোমাদের কেউ লোকদের ইমামতি করবে, তখন যেন সে নামায হালকা করে, কারণ তাদের মধ্যে দুর্বল, অসুস্থ ও বয়স্ক লোক থাকে। আর যখন সে একা নামায পড়বে, তখন যত ইচ্ছা দীর্ঘ করবে”। [বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান নং ৭০৩]
৩-প্রয়োজনে ইমামতির সময় অন্যকে স্থলাভিষিক্ত করাঃ
ইমামতিকালে যদি ইমামের অযু নষ্ট হয়ে যায় কিংবা আরো অন্য কারণে তাকে মাঝখানে নামায ছাড়তে হয়, তাহলে তার পিছনে উপস্থিত মুক্তাদীদের কাউকে তার স্থানে করে দিবে। ইমাম কাউকে নির্ধারণ না করলে স্বইচ্ছায় মুক্তাদীদের কেউ ইমাম হয়ে যাবে এবং বাকি নামায পূরণ করবে। এমতাবস্থায় সে ইমামের নায়েব/স্থলাভিষিক্ত ইমাম। সে নতুন করে নামায শুরু থেকে পড়াবে না; বরং যেখান থেকে পূর্বের ইমাম নামায ছেড়েছে সেখান থেকে বাকি নামায পূর্ণ করবে। উমর (রাযিঃ) কে ইমামতি কালে শত্রু ছুরি দ্বারা আঘাত করলে তিনি সাহাবী আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাযিঃ) কে স্থলাভিষিক্ত করেন। [ফাতাওয়া সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদ,৭/৩৯৩-৩৯৫]
উল্লেখ্য, ইমাম যদি অযু ছাড়াই নামায পড়ায়, তাহলে তার নামায বাতিল কিন্তু মুক্তাদীদের নামায সহীহ। [ফাতহুল বারী,২/২৪৩] আর যদি কোন নির্দিষ্ট মুক্তাদী তার ইমামের বেঅযু সম্পর্কে জানতে পারে, কিন্তু অন্যরা তা না জানতে পারে, তাহলে যে জানে তার নামায বাতিল কিন্তু যারা জানে না তাদের নামায শুদ্ধ। এমতাবস্থায় ইমাম যদি নামাযরত অবস্থায় নিজের অযু নেই তা জানতে পারে, তাহলে সে ততক্ষণাৎ অন্যকে তার স্থানে স্থলাভিষিক্ত করে অযু করবে, আর নামায শেষ করার পর জানতে পারলে সে অযু করে নিজের নামায পুনরায় আদায় করবে।
অনুরূপ কোন ইমাম যদি জেনে-বুঝে নাপাকী নিয়ে নামায আদায় করে, তাহলে তার নামায বাতিল। কিন্তু সে যদি অজান্তে নাপাকী নিয়ে নামায পড়ে অতঃপর নামাযরত অবস্থায় তা জানতে পারে, তাহলে নামাযরত অবস্থায় তা দূর করা সম্ভব হলে দূর করবে যেমন জুতা, মোজা, টুপি বা পাগড়িতে নোংরা লেগে থাকলে তা খুলে ফেলে দিবে এবং নামায পূরণ করবে।[আবু দাঊদ নং (৬৫০/ইবনু খুযায়মা নং (১০১৭] আর নামাযরত অবস্থায় তা দূর করা সম্ভব না হলে নামায ছেড়ে অন্যকে ইমাম করে দিয়ে পাক হবে। তবে নামায শেষ করার পর তা জানতে পারলে সহীহ মতানুসারে তাদের পুনরায় নামায আদায় করতে হবে না। [ মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া,২২/১৮৪-১৮৫]
৪-নামাযে ছোট-বড় সূরা পাঠ ও বিশেষসূরা চয়নে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর তরীকা অবলম্বনঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরা ফাতিহার পর সব নামাযে এক ধরনের সূরা পড়তেন না আর না সব নামাযের সময়সীমা এক হত; বরং তিনি কোন ওয়াক্তে দীর্ঘ সূরা পড়তেন আবার কোন সময়ে ছোট। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শেষের রাকাআতগুলির তুলনায় প্রথম রাকাআতের কিরাআত দীর্ঘ করতেন। তাই ইমামকে মুক্তাদীদের অবস্থা বুঝে এসব মুস্তাহাব বিষয়গুলিরও খেয়াল রাখা উচিৎ।
  • আবু ক্বাতাদাহ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেনঃ“নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যহরের প্রথম দুই রাকাআতে সূরা ফাতিহা এবং আরো দুটি সূরা পড়তেন, প্রথমটি লম্বা করতেন এবং দ্বিতীয়টি সংক্ষিপ্ত আর অনেক সময় তাঁর আয়াত পড়া শোনা যেত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসরে সূরা ফাতিহা এবং আরো দুটি সূরা পাঠ করতেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের নামাযের প্রথম রাকাআত দীর্ঘ করতেন আর দ্বিতীয়টি সংক্ষিপ্ত”। [বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান, হাদীস নং ৭৫৯]  
  • অন্য বর্ণনায় এসেছে, “তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম রাকাআত যতখানি দীর্ঘ করতেন ততখানি দ্বিতীয় রাকাআতে করতেন না। এই ভাবে তিনি আসর ও সাকালেও করতেন”। [বুখারী, নং ৭৭৬]
  • অনুরূপ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমআর ফজরে, জুমআর নামাযে, দুই ঈদের নামাযে এবং বিতরের নামাযে বিশেষ সূরা বেশীরভাগ সময়ে পড়তেন, তাই ইমামকেও তা করা মুস্তাহাব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমআর দিনে ফজরের প্রথম রাকাআতে আলিফ্ লাম্ মীম তানজীল্ আস্ সাজদাহ (সূরা সাজদাহ) এবং দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা দাহ্ র পাঠ করতেন। [বুখারী, জুমআ অধ্যায়, নং৮৯১] আর জুমআর নামাযের প্রথম রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ‘আ’লা’ (সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল্ আ’লা) এবং দ্বিতীয় রাকাআতে ‘গাশিয়াহ্’ (হাল্ আতাকা হাদীসুল্ গাশিয়াহ) পাঠ করতেন। এমনকি জুমআর দিনে যদি ঈদ একত্রিত হত, তাহলে জুমআহ ও ঈদ উভয় নামাযে এই দুটি সূরা পাঠ করতেন। [মুসলিম, জুমআহ অধ্যায়ঃ নং ২০২৫/আবু দাঊদ/তিরমিযী]
  • তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমআর নামাযের প্রথম রাকাআতে সূরা ‘জুমুআহ্’ এবং দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা ‘মুনাফেকূন’ ও পাঠ করতেন। [মুসলিম, অধ্যায় জুমুআহ, নং২০২৩/আবু দাঊদ নং১১২৪/তিরমিযী নং৫১৯]
  • তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক সাথে তিন রাকাআত বিতর পড়লে প্রথম রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে ‘কাফেরূন’ এবং তৃতীয় রাকাআতে সূরা ‘ইখলাস’ পাঠ করতেন। [সহীহ সুনান নাসাঈ নং১৬০৬]
৫-সালাম ফিরানোর পর মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে ফিরে বসাঃ
ইমাম সালাম ফিরানোর পর কিবলামুখী হয়ে বেশীক্ষণ থাকবেন না বরং; তিনিবার আস্তাগ্ ফিরুল্লাহ এবং একবার আল্লাহুম্মা আনতাস্ সালাম ও মিনকাস্ সালাম তাবারাকতা ইয়া যাল্ জালালি ওয়াল্ ইকরাম বলতে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ শেষে মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে বসবেন, এটাই সুন্নত। মুক্তাদীদের দিকে ফিরার সময় ডান দিক কিংবা বাম দিকে ঘুরে অতঃপর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসা, উভয় নিয়ম প্রমাণিত। [বুখারী, আযান অধ্যায়ঃ নং ৮৫২, মুসলিম, অধ্যায়ঃ মুসাফেরীনদের নামায, নং৭০৮/শারহুল মুমতি,৪/৩০৫-৩০৬]

বিঃ দ্রঃ লেখকের ভিডিও লেকচার শুনতে ইউটিউব সার্চে লিখুন Abdur Raquib Bokhari-Madani
দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার, খাফজী, সউদী আরব।

ইমাম ও ইমামতি (পর্ব-২)

ইমাম ও ইমামতি (পর্ব-২)


 
ইমাম ও ইমামতি (পর্ব-২)
লেখক: আব্দুর রাকীব মাদানী
দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার খাফজী (সউদী আরব)
১-যার অবস্থা অজ্ঞাত, এমন ইমামের পিছনে নামাযঃ
কোথাও অপরিচিত ইমামের পিছনে নামায আদায় করার সময় মুসাল্লীকে ইমামের দ্বীনী অবস্থা সম্পর্কে জানা বা খোঁজ নেওয়া জরূরী নয়; বরং তার বাহ্যিক অবস্থাই গ্রহণীয়। আবুল্ ইয্ শারহু আক্বীদাতিত্ ত্বাহাবিয়ায় বলেনঃ ‘মুক্তাদীর জন্য ইমামের আক্বীদা জানা শর্ত নয় আর না তাকে পরীক্ষা করবে এই বলে যে, তোমার আক্বীদা কি? বরং সে অবস্থা অজ্ঞাত এমন ইমামের পিছনে নামায আদায় করবে’। [শারহুল্ আক্বীদা আত্ ত্বাহাবিয়্যাহ,২/৫৬৮]
সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদকে জিজ্ঞাসা করা হয়, যে ব্যক্তি কোন শহরে বা গ্রামে অবস্থান করে, তার উপর জরূরী কি যে, সে নামায আদায়ের পূর্বে তার ইমামের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে?
উত্তরে পরিষদ বলেনঃ ‘তার উপর এটা জরূরী নয় এবং অজ্ঞাত ইমামের পিছনে তার নামায পড়া বৈধ কিন্তু যদি তার মধ্যে এমন কিছু দেখে যা দ্বীনে মন্দ। কারণ মুসলিমের অবস্থা সম্পর্কে নীতি হল, তাদের সম্পর্কে সুধারণা রাখা, যতক্ষণে এর বিপরীত প্রকাশ না পায়’। [ফাতাওয়াল্ লাজনা,৭/৩৬৩]
২-শির্ককারী ইমামের পিছনে নামাযঃ
মুসলিম হিসাবে পরিচিত কিন্তু সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট দুআ-প্রার্থনা করে, নবী, অলী ও সৎ লোকদের আল্লাহর নৈকট্যকারী মনে করে, মৃত কথিত অলীদের উদ্দেশ্যে কুরবানী করে, মানত করে, কবরস্থ সৎ দরগাহ বাসীকে কল্যাণকারী বা ক্ষতি সাধনকারী বিশ্বাস করে, এমন ইমামের পিছনে নামায বৈধ কি? এ বিষয়ে উপরোক্ত সউদী ফাতাওয়া বোর্ডকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তারা তার পিছনে নামায অবৈধ বলেছেন। কারণ এসব ইবাদত বা এর কোন অংশ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য করা শির্ক, যা মানুষকে ইসলামের গোণ্ডী থেকে বের করে দেয়। [দেখুন, ফাতাওয়াল্ লাজনা আদ্দায়িমাহ,৭/৩৫৩-৩৫৯, বিষয়ঃ মুশরিকের পিছনে নামায]
৩-ফাসেক এবং বিদআতী ইমামের পিছনে নামাযঃ [ফাসেক, বড় গুনাহকারী বা বারংবার ছোট গুনাহকারী ব্যক্তি। আর এখানে বিদআতী বলতে ঐ বিদআতকে বুঝানো হয়েছে যা, কুফর নয়।]
ক-উপরোক্ত মন্দ গুণের অধিকারী ইমামের পিছনে নামায সহীহ। বিশেষ করে সেই ইমাম যদি রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক নির্ধারিত হয় এবং তাকে অপসারণ করার ক্ষমতা না থাকে কিংবা তাকে সরাতে গিয়ে যদি ফেতনা-ফাসাদের আশংকা থাকে, তাহলে তার পিছনে নামায শুদ্ধ। এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের একটি আক্বীদাও। ইমাম ত্বাহাবী বলেনঃ ‘আমরা আহলে কিবলার প্রত্যেক পরহেযগার এবং গুনাহগার ব্যক্তির পিছনে নামায জায়েয মনে করি’। [শারহুল আক্বীদা আত্ ত্বাহাবিয়া,২/৫৬৬]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “লোকদের ইমামতি করবে, তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অধিক পাঠকারী” ।
[মুসলিম, নং (৬৭৩)] এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ আম/ব্যাপক।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক প্রকার ইমামের সম্পর্কে বলেনঃ “তারা (ইমামেরা) তোমাদের নামায পড়াবে, যদি তারা সঠিক করে, তাহলে তোমাদের নামাযের সওয়াব তোমাদের জন্যে আর যদি সে ভুল করে তাহলে তোমাদের সওয়াব তোমাদের জন্যে এবং তাদের ভুল তাদের জন্যে”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৯৪]
সাহাবাগণের মধ্যে ইবনে উমার যিনি সুন্নতের প্রতি সদা আগ্রহী হিসাবে পরিচিত, তিনি অত্যাচারী গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসেূফের পিছনে নামায সম্পাদন করতেন। [বুখারী, হজ্জ অধ্যায়, নং ১৬৬০]
ইমাম আহমদ সহ তাঁর যুগের উলামাগণ মুতাযেলীর পিছনে জুমআ ও ঈদের নামাযে হাজির হতেন। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ,৩/২২]
সউদী স্থায়ী উলামা পরীষদের ফাতওয়ায় বিদআতী ইমামের পিছনে নামায সম্পর্কে বলা হয়, যদি বিদআত কুফর ও শির্ক পর্যায়ের হয়, তাহলে তার পিছনে নামায অশুদ্ধ আর বিদআতকারীর বিদআত যদি কুফরী পর্যায়ের না হয়, যেমন মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পড়া, তাহলে তার নিজের নামায শুদ্ধ এবং তার পিছনে নামায আদায়কারীর নামাযও শুদ্ধ। [ফাতওয়া নং (১২০৮৭),৭/৩৬৪-৩৬৫]
এ বিষয়ে একটি মূলনীতি হচ্ছে, ‘যার নিজের নামায শুদ্ধ তার ইমামতীও শুদ্ধ’। [আশ্ শারহুল্ মুমতি, ইবনে উসাইমীন, ৪/২১৭]
এসব বিধান ও নিয়মের মূল কারণ হচ্ছে, ইসলামী ঐক্য ও সংহতি রক্ষা। ইসলাম সদা ঐক্যের আদেশ দেয় এবং মতভেদ থেকে সতর্ক করে। তাই দেখা যায়, যেখানে মানুষ ইমামদের সাধারণ ভুল-ত্রুটি নিয়ে মতভেদ করে, সেখানে লোকেরা দলে দলে বিভক্ত হয়, এক পর্যায় একাধিক মসজিদ তৈরি হয়, এমনকি গ্রাম ও মহল্লা ভেঙ্গে আপসে ঘোর শত্রুতায় লিপ্ত হয়।
কিন্তু বিদআতী ও ফাসেক ইমামের বর্তমানে যদি মুআহ্হিদ ও মুত্তাকী ইমামের পিছনে নামায পড়া সম্ভব হয়, তাহলে পরহেযগার ও সহীহ আক্বীদা পোষণকারী ইমামের পিছনে নামায পড়া উত্তম। কারণ, অবশ্যই ফাসেক থেকে মুত্তাক্বী উত্তম এবং বিদআত থেকে সুন্নত উত্তম। আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই বেশী সম্মানীয় যে ব্যক্তি বেশী মুত্তাক্বী।” [সূরা হুজুরাত/১৩]
উদাহারণ স্বরূপ যদি কারো বাড়ির পার্শে দুটি মসজিদ থাকে, একটির ইমাম সুন্নাহ ও তাক্বওয়ার অধিকারী আর অপরটির ইমাম বিদআত ও ফিসকে লিপ্ত, তাহলে সে প্রথমটির পিছনে নামায আদায় করবে; যদিও সেই মসজিদটি দূরে অবস্থিত হয়।
৪-নাবালেগের ইমামতীঃ
বালেগ এর বিপরীত নাবালেগ। শরীয়ার দৃষ্টিতে নিম্নের তিনটি বিষয়ের যে কোন একটির প্রকাশ পাওয়া বালেগ হওয়া বুঝায়।
  • ১-পনের বছর বয়স পূরণ হওয়া।
  • ২-গুপ্তাঙ্গের চতুর্পার্শে লোম উদগত হওয়া।
  • ৩-যৌন চেতনার সাথে জাগ্রত বা নিদ্রাবস্থায় বীর্যপাত হওয়া।
আর মহিলাদের ক্ষেত্রে আর একটি বিষয় যোগ হবে, তা হচ্ছে মাসিক স্রাব আসা। মাসিক স্রাব প্রকাশ মহিলাদের বালেগা হওয়ার আলামত। [শারহুল্ মুমতি, ইবনে উসায়মীন,৪/২২৪]
ছয়-সাত বছরের নাবালেগ ছেলে যদি নামাযীদের মধ্যে অধিক কুরআন মুখস্থকারী হয়, তাহলে তার ইমামতি সিদ্ধ। আমর বিন সালামাহ বলেনঃ আমাকে তারা (গোত্রের সাহাবারা) ইমাম বানিয়ে দেয়। সেই সময় আমার বয়স ছয় কিংবা সাত বছর ছিল। কারণ তারা নিজেদের মাঝে খোঁজে দেখে যে, আমারই সর্বাধিক কুরআন মুখস্থ রয়েছে। [বুখারী, অধ্যায়, মাগাযী, অনুচ্ছেদ নং ৫৩, হাদীস নং ৪৩০২]
৫-অন্ধ ব্যক্তি ও দাসের ইমামতিঃ
অন্ধ ব্যক্তির ইমামতি নিঃসন্দেহে বৈধ। আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে মাকতূমের পূত্রকে মদীনায় দুইবার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। তিনি তাদের ইমামতি করতেন এবং তিনি অন্ধ ছিলেন। [আবু দাঊদ, সালাত অধ্যায়, নং৫৯৫/আহমাদ,৩/১৯২]
ইবনে উমার থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পূর্বে মদীনার কুবার নিকট হিজরতকারীদের আবু হুযায়ফার (রাযিঃ) দাস সালেম ইমামতি করতেন কারণ তিনি বেশী কুরআন মুখস্থকারী ছিলেন। [বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান, নং৬৯২]
ইমাম বুখারী উক্ত হাদীসের অনুচ্ছেদ যেই শিরোনামে রচনা করেন, তা হলঃ ‘দাস ও স্বাধীনকৃত দাসের ইমামতি’।
আয়েশা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তারঁ জনৈক দাস তাঁর ইমামতি করতো। [মুগনী,৩/২৬]
৬-বোবা ও বধির ব্যক্তির ইমামতিঃ
বোবা ব্যক্তি, সে জন্মগত বোবা হোক কিংবা পরে কোন কারণে বোবা হোক, তার ইমামতি জায়েয নয়; কারণ সে নামাযের রুকন ও ওয়াজিব উচ্চারণ করতে অক্ষম। যেমন তকবীরে তাহরীমা বলা, সূরা ফাতিহা পাঠ করা, তাশাহ্হুদ পাঠ করা ইত্যাদি। তবে তার নিজের নামায সহীহ। [মুগনী,৩/২৯,শারহুল মুমতি,৪/২২৬-২২৭]
বধির ব্যক্তির ইমামতির সম্পর্কে কিছু উলামা বলেনঃ যেহেতু তার মাধ্যমে নামাযের কাজ ও শর্ত সমূহের ব্যাঘাত ঘটে না, তাই তার অবস্থা অন্ধ ব্যক্তির ন্যায়। আর যেমন অন্ধের ইমামতি জায়েয তেমন তারও জায়েয। কিন্তু কিছু উলামা এই বলে বধির ব্যক্তির ইমামতি অশুদ্ধ বলেছেন যে, যেহেতু সে ভুল করলে তাকে সুবহানাল্লাহ বলে ভুলের সংকেত দেওয়া অনর্থক, তাই তার ইমামতি সিদ্ধ নয়। [মুগনী,৩/২৯]
মূলতঃ বোবা ও বধির ব্যক্তির ইমামতি সম্পর্কে স্পষ্ট কোন দলীল বর্ণিত হয় নি, তাই উলামাগণের মধ্যে এই মতভেদ।
৭-মহিলার ইমামতিঃ
মহিলার জন্য মহিলার ইমামতি বৈধ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মু অরাকা (রাযিঃ) কে আদেশ করেন, তিনি যেন তার বাড়ির সদস্যদের ইমামতি করেন। [আবু দাঊদ, সালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ মহিলার ইমামতি,নং ৫৯১, ইবনু খুযায়মা বর্ণনাটিকে সহীহ বলেছেন]
আয়েশা (রাযিঃ) হতে প্রমাণিত, তিনি মহিলাদের ইমামতি করতেন এবং লাইনের মাঝে দাঁড়াতেন। [মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক,নং৫০৭৬, দারাকুত্বনী/বায়হাক্বী]
তবে তারা ইমামতির সময় পুরুষের মত লাইন থেকে আগে বেড়ে পৃথক স্থানে দাঁড়াবে না; বরং লাইনের মাঝেই অবস্থান করতঃ ইমামতি করবে। এটা কিছু সাহাবিয়ার আমল দ্বারা প্রমাণিত। [আর রাওদা আন নাদিয়্যাহ, সিদ্দীক হাসান খাঁন,১/৩২২]
কিন্তু মহিলার জন্য বৈধ নয় যে, তারা পুরুষের ইমামতি করবে। [প্রাগুক্ত,৩১২-৩১৩] এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল, খুলাফায়ে রাশেদীনের আমল এবং ধারাবাহিক মুসলিম উম্মার আমলই বড় প্রমাণ, যে তাঁরা কেউ মহিলাকে পুরুষের ইমাম নিযুক্ত করেন নি আর না তাদের যুগে এমন কোন নজীর ছিল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘ঐ সম্প্রদায় কখনো সফলকাম হতে পারে না, যারা কোন মহিলাকে তাদের বিষয়াদির নেতা নিযুক্ত করে”। [বুখারী, অধ্যায়ঃ মাগাযী, নং৪৪২৫] যেহেতু ইমামতি এক প্রকারের নেতৃত্ব, তাই তাদের এ পদে নিযুক্ত করা অবৈধ। [দেখুন শারহুল মুমতি,৪/২২২]
৮-রুকু, সাজদা, কিয়াম, কুঊদ করতে অপারগ ব্যক্তির ইমামতিঃ
সাধারণতঃ রুকু, সাজদা, কিয়াম, কুঊদ সহ নামাযের অন্যান্য রুকন পালন করতে অক্ষম ব্যক্তি এ সব পালনে সক্ষম ব্যক্তির ইমামতি করতে পারে না। কারণ এ ক্ষেত্রে ইমামের অবস্থা মুক্তাদী অপেক্ষা দুর্বল, যা ইমামের জন্য বাঞ্ছনীয় নয়। তবে মসজিদের নির্ধারিত সবল ইমাম যদি কোন কারণে নামায পড়ানোর সময় কিয়াম করতে (দাঁড়াতে) অক্ষম হয়ে পড়ে কিংবা অসুস্থতার কারণে শুরু থেকেই দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম হয়, তাহলে সেই ইমাম বসে নামায পড়াতে পারেন। কিন্তু এই সময় দাঁড়াতে সক্ষম মুক্তাদীগণ বসে নামায পড়বে না দাঁড়িয়ে? এ বিষয়ে উত্তম মত হল, ইমাম যদি প্রথমে দাঁড়ানো অবস্থায় নামায শুরু করে থাকেন আর মাঝে বসে পড়ান, তাহলে মুক্তাদীগণ দাঁড়িয়ে নামায সম্পাদন করবেন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যুর পূর্বে অসুস্থকালে আবু বকর (রাযিঃ) দাঁড়িয়ে নামায শুরু করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাম পার্শে বসে ইমামতি করেন আর আবু বকর সহ অন্যান্য সাহাবাগণ দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে থাকেন। কারণ এখানে প্রথমে আবু বকর (রাযিঃ) দাঁড়িয়ে ইমামতি শুরু করেছিলেন। আর যদি ইমাম শুরু থেকেই বসে নামায পড়ান, তাহলে মুক্তাদীরাও বসে নামায পড়বেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যখন ইমাম বসে নামায পড়াবে তখন তোমরাও বসে নামায পড়বে”। [বুখারী, আযান অধ্যায়ঃ নং৬৮৯/ মুসলিম, সালাত অধ্যায়, নং৪১১/ বিস্তারিত দেখুন, শারহুল্ মুমতি,৪/২২৮-২৩৬]
৯-উম্মী তথা অজ্ঞ ব্যক্তির পিছনে নামাযঃ
এখানে উম্মী বা অজ্ঞ বলতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে সূরা ফাতেহা ভাল করে পড়তে পারে না; যদিও সে অন্য সূরা ভাল করে পড়তে সক্ষম হয়। যেমন ‘রা’ কে ‘লা’ পড়ে কিংবা হরকত ভুল পড়ে যেমন, যেরের স্থানে যবার পড়ে বা যবারের স্থানে যের বা পেশ পড়ে, যার ফলে শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ (ইহ্ দিনা) অর্থ আমাদের সঠিক পথ দেখাও এর স্থানে পড়ে (আহ্ দিনা) অর্থ আমাদের হাদিয়া-উপহার দাও কিংবা (আন্‌ আম্ তা) অর্থ তুমি অনুগ্রহ করেছো এর স্থানে পড়ে (আন্ আম্ তু) অর্থ আমি অনুগ্রহ করেছি। তাহলে এমন উম্মী ইমামের পিছনে শুদ্ধ সূরা ফাতিহা পাঠকারীর নামায বৈধ নয়। তবে উপস্থিত সকল লোক যদি সূরা ফাতিহা অশুদ্ধ পাঠকারী হয়, তাহলে তাদের একে অপরের ইমামতি বৈধ। কারণ আল্লাহ তাআ’লা সাধ্যের অতিরিক্ত জরূরী করেন না। কিছু উলামার মতে সূরা ফাতিহা অশুদ্ধ পাঠকারীর পিছনে শুদ্ধ সূরা পাঠকারীর নামায বৈধ কিন্তু এটা উচিৎ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “লোকদের ইমামতি করবে তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অধিক পাঠকারী”। [মুসলিম, অধ্যায়ঃ মাসাজিদ, নং ৬৭৩ এবং ২৯০, আরো দেখুন, আল্ মুগনী,৩/২৯-৩০, শারহুর্ মুমতি,৪/২৪৫-২৪৯, ফতাওয়াল লাজনা,৭/৩৪৮]
১০-কিছু আনুসাঙ্গিক বিষয়ঃ
ক-ইমামতির জন্য বিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। [সউদী স্থায়ী ফাতাওয়া পরিষদ,৭/৩৮২]
খ-ব্যভিচারীর সন্তানের ইমামতি অন্য মানুষের ন্যায়। তার মায়ের পাপের কারণে তার ইমামতি প্রভাবিত হবে না। [প্রাগুক্ত ফাতাওয়া পরিষদ,৭/৩৮৮]
গ-ইমামতির সময় অযু নষ্ট হলে অন্য কোন মুক্তাদীকে ইমাম নিযুক্ত করা বৈধ। [প্রাগুক্ত,৭/৩৯৫]

ইমাম ও ইমামতি-1

ইমাম ও ইমামতি


 
ইমাম ও ইমামতি
লেখক: আব্দুর রাকীব (মাদানী)
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী
আল্ হাল হামদুলিল্লাহ, ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ্, আম্মা বাদ:
ইমাম ও ইমামতি ইসলাম ধর্মের এবং মুসলিম সমাজের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল প্রয়োজনীয় বিষয়। একটি দেশ থেকে নিয়ে একটি গ্রাম পর্যন্ত এমনকি একটি পরিবারেও এই পদের প্রয়োজনীয়তা লক্ষণীয়। তাই এই বিষয়টির সম্পর্কে আমাদের সমাজের প্রত্যেক ইমামকে বিশেষ ভাবে এবং অন্যান্য মুসলিমদের সাধারণ ভাবে জ্ঞান রাখা আবশ্যক। উক্ত কারণে বিষয়টির অবতারণা। আল্লাহ যেন সঠিক লেখার এবং তার প্রতি আমল করার তাওফীক দেন। আমীন।
ইমাম শব্দের আভিধানিক অর্থ:
আরবী ভাষার বিশিষ্ট অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ উল্লেখ হয়েছে, ‘মানুষ যার অনুসরণ করে, তাকে ইমাম বলে’।
ইবনু সীদাহ বলেন: ‘প্রধান ব্যক্তি কিংবা মানুষের অনুকরণীয় ব্যক্তিকেই ইমাম বলা হয়। এর বহুবচন হচ্ছে, ‘আইম্মাহ’-ইমামগণ। [লিসানুল আরব, ইবনে মনজুর,১২/২৪]
ফিকাহ বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, ইমাম তাকেই বলা হয় কোন সম্প্রদায় যার অনুসরণ করে। সেই সম্প্রদায় সঠিক পথের অধিকারী হোক অথবা পথ ভ্রষ্ট হোক হোক।
সঠিক পথের অধিকারী অর্থে আল্লাহ বলেছেন: “আর তাদের বানিয়েছিলাম ইমাম (নেতা) তারা আমার নির্দেশে মানুষকে সঠিক পথ দেখাত।” [আম্বিয়া/৭৩]
পথ ভ্রষ্ট অর্থে: আল্লাহ বলেন: “আমি তাদের ইমাম (নেতা) করেছিলাম। তারা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত, কিয়ামতের দিন তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।” [কাসাস/৪১] [ ফিকহ্ বিশ্বকোষ,৬/২১৬-২১৭]
আর ইমামাহ্-প্রচলিত ভাষায় যাকে আমরা ইমামতি বলি- তা আরবী আম্মা-ইয়াউম্মু শব্দের মাসদার বা উৎস, যার আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা। শব্দটি অগ্রবর্তী হওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়। আরবী ভাষায় বলা হয়, আম্মাহুম এবং আম্মা বিহিমঃ অর্থাৎ যখন সে অগ্রবর্তী হয়। [ঐ, ৬/২০১]
ইমামতির পারিভাষিক অর্থ:
ফকীহ তথা ইসলামী বিদ্বানগণের পরিভাষায় ইমামত দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা:
  • ইমামা কুবরা (বড় ইমামত)
  • ইমামা সুগরা (ছোট ইমামত)।
ইসলামী পরিভাষায় বড় ইমামত হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিনিধি হিসাবে দ্বীন ও দুনিয়ার সাধারণ নেতৃত্ব প্রদানকরা। [প্রাগুক্ত,৬/২১৬] যাকে খলীফা, রাষ্ট্রপ্রধান বা দেশের প্রধান নেতা বলা যেতে পারে।
আর ছোট ইমামত হচ্ছে নামাযের ইমামত। যে ব্যক্তি নামাযের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয় আর নামাযীরা তাঁর অনুকরণ করে থাকে। যেহেতু তিনি অনুকরণীয় এবং অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী সেহেতু তাঁকে ইমাম বলা হয়।
অবশ্য ইমাম শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। শব্দটির আভিধানিক অর্থকে কেন্দ্র করে এমন ব্যক্তিকেও ইমাম বলা হয়, যে বিশেষ জ্ঞানে পারদর্শী এবং সেই জ্ঞানে সে অনুকরণীয় । তাই হাদীস শাস্ত্রে বুখারী (রহ) কে ইমাম বুখারী বলা হয়। ফিকাহ শাস্ত্রে আবু হানীফা, মালেক, শাফেয়ী ইত্যাদি উলামাগণের নামের শুরুতে ইমাম লেখা হয়। এ সবই এই শব্দের ব্যাপক ব্যবহারের উদাহরণ। তবে আলোচ্য বিষয়ে আমরা ছোট ইমামত তথা নামাযের ইমামতের আলোচনা করব। ইনশাআল্লাহ।
নামাযের ইমামতের গুরুত্ব ও ফযীলতঃ
১- ইমামতি করা দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা স্বয়ং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারা জীবন করে গেছেন। অতঃপর তাঁর মৃত্যুর পর চার খলীফা তা সম্পাদন করেছেন এবং এখনও মুসলিম সমাজের উত্তম ব্যক্তিরাই সাধারণত: সেই উত্তম কাজটি পালন করে থাকেন।
২- পাঁচ ওয়াক্ত নামায সম্পাদন করা ইসলামের দ্বিতীয় রোকন এবং ইসলামের স্পষ্ট প্রতীক যা মহান আল্লাহ জামাআতবদ্ধ ভাবে আদায় করার আদেশ করেছেন। আর সেই আদেশ ইমাম ব্যতীত বাস্তবায়িত হয় না।
৩- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমাম ও মুয়াযযিনের জন্য এই বলে দুয়া করেন:
“الإمام ضامن والمؤذن مؤتمن، اللهم أرشد الأئمة واغفر للمؤذنين” أخرجه أبوداود والترمذي
“ইমাম হচ্ছে জিম্মাদার আর মুয়াজ্জিন আমানতদার, হে আল্লাহ! তুমি ইমামদের সঠিক পথ দেখাও কর এবং মুয়াজ্জিনদেরকে ক্ষমা কর”। [আবু দাউদ, নং৫১৭ / তিরিমিযী, নং ২০৭/ সহীহ সুনান আবুদাঊদ, ১/১০৫]
ইমামতীর অধিক হকদার কে?
এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
يَؤمُّ القومَ أقرئهم لكتابِ اللهِ، فإن كانوا في القراءةِ سواء فأعلمهم بالسنة فإن كانو في السنة سواء فأقدمهم هجرة، فإن كانوا في الهجرة سواء فأقدمهم سلما، ولا يؤَمَّنَّ الرجلُ الرجلَ في سلطانه، و لا يقعد في بيته على تكرمته إلا بإذنه” [رواه مسلم]
“লোকদের ইমামতি করবে ঐ ব্যক্তি যে তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব সব চেয়ে বেশী পাঠ করতে পারে। যদি তারা পাঠ করার ক্ষেত্রে সমমানের হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সুন্নতের অধিক জ্ঞানী হবে সে ইমামতি করবে। যদি সুন্নতের জ্ঞানে সকলে বরাবর হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম হিজরতকারী সে ইমামতি করবে। যদি তারা সকলে হিজরতের ক্ষেত্রেও বরাবর হয় তবে তাদের মধ্যে আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে সে তাদের ইমাতি করবে। কোন ব্যক্তি যেন কোন ব্যক্তির অধীনস্থ স্থানে তার অনুমতি ব্যতীত ইমামতী না করে এবং কোন ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত আসনে যেন তার অনুমতি ব্যতীত না বসে”। [মুসলিম, অধ্যায়, মাসাজিদ এবং নামাযের স্থান সমূহ, হাদীস নং ৬৭৩]
সহীহ মুসলিমে এই বর্ণনার ঠিক পরের বর্ণনায় আগে ’ইসলাম গ্রহণের স্থানে বয়সে বড় শব্দটি এসেছে।
উপরের বর্ণনানুযায়ী ইমামতির বেশী হকদার ব্যক্তিবর্গের ধারাবাহিকতা এইরূপ:
  • ১- কুরআন সব চেয়ে বেশী পাঠকারী। এখানে সব চেয়ে বেশী পাঠকারী বলতে যার কুরআন সব চাইতে বেশী মুখস্থ আছে তাকে বুঝানো হয়েছে। কারণ আমর বিন সালমার হাদীসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদেশ এই ভাবে উল্লেখ হয়েছে, “যখন নামাযের সময় হবে, তখন তোমাদের মধ্যে কেউ আযান দিবে এবং তোমাদের মধ্যে যার অধিক কুরআন মুখস্থ আছে সে ইমামতি করবে’’। [বুখারী, অধ্যায়, মাগাযী, হাদীস নং ৪৩০২]
  • ২- সকলে কুরআন মুখস্থের ক্ষেত্রে সমান হলে সুন্নতের ব্যাপারে অধিক জ্ঞানী।
  • ৩- সুন্নতের জ্ঞানেও সকলে বরাবর হলে যে ব্যক্তি কুফরের দেশ হতে ইসলামের দেশে আগে হিজরতকারী।
  • ৪- হিজরতের ক্ষেত্রে সকলে বরাবর হলে, যে ইসলাম গ্রহণে অগ্রবর্তী।
  • ৫- আর ইসলাম গ্রহণে সবাই বরাবর হলে, যে বয়সে বড়। যেমন সহীহ মুসলিমের পরের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
  • উপরে বর্ণিত পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের তরতীব নির্ণয়ে বিভিন্ন উলামা ও মাজহাবের কিছু মতভেদ থাকলেও হাদীসে বর্ণিত ধারাবাহিকতা প্রাধান্য পাবে। তবে চতুর্থের স্থানে পঞ্চম হওয়ার সম্ভাবনা হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। অর্থাৎ হিজরতের দিক দিয়ে সকলে বরাবর হলে বয়সে বড় বেশী হকদার না ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী হকদার? এ বিষয়ে হাদীসের শব্দের ধারাবাহিকতায় পার্থক্য দেখা যায়। তাই কেউ বয়সে বড়কে প্রাধান্য দিয়েছে আর কেউ ইসলাম আগে গ্রহণকে প্রাধান্য দিয়েছে। [শারহু মুসলিম,৫ম খণ্ড, ১৭৫-১৭৭/ আর রাওযা আন নাদিয়্যাহ, মুহাম্মদ সিদ্দীক হাসান খান, ১/৩২০/ মুগনী, ইবনু কুদামাহ, ৩/১১১৬]
উপরোক্ত বিষয়ে আরো কিছু তথ্য:
  • ক- উপরোক্ত ধারাবাহিকতা বজায় রাখার আদেশ মোস্তাহাব আদেশ, শর্ত নয় আর না ওয়াজিব। তাই অগ্রাধিকার প্রাপ্তের উপস্থিতিতে অনগ্রাধিকার প্রাপ্তের ইমমতি ফুকাহাদের সর্বসম্মতিক্রমে বৈধ। [আল্ মাওসূআহ আল ফিকহিয়্যাহ, ৬/২০৯]
  • খ- এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা তখন প্রযোজ্য হবে, যখন মসজিদে নির্ধারিত ইমাম থাকবে না। আর যদি মসজিদে ইমাম নির্ধারিত থাকে তাহলে সেই ইমামতি করার বেশী অধিকার রাখে; যদিও তার থেকে বেশী কুরআন পাঠকারী ও সুন্নত তথা অন্যান্য গুণের লোক উপস্থিত থাকে। কারণ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ‘‘কোন ব্যক্তি যেন কোন ব্যক্তির অধীনস্থ স্থানে কখনো ইমামতি না করে।” [শারহু মুসলিম,৫/১৭৭]
  • গ- হ্যাঁ, তবে সেই স্থানে যদি বড় ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান) উপস্থিত হন, তাহলে নির্ধারিত ইমামও আর ইমামতি করার বেশী হোকদার হবে না; বরং সেই বড় ইমাম তখন ইমামতি করার বেশী হকদার হবেন। কারণ তাঁর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ব্যাপক। [নায়লুল আউতার,৩/২০২/ শারহু মুসলিম,৫/১৭৭]
  • ঘ- হাদীসে বর্ণিত উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যে যদি সকলে সমান হয়, তাহলে কী করতে হবে? এ বিষয়ে সেই হাদীসে আরো কিছু বলা হয় নি। তবে অন্যান্য দলীলের আলোকে ইসলামী পণ্ডিতদের অনেকে মনে করেন, তাহলে তাদের মধ্যে অধিক পরহেজগার ব্যক্তি অগ্রাধিকার পাবে। কারণ আল্লাহ বলেন: “অবশ্যই আল্লাহ নিকট তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহ ভীরুই বেশী সম্মানীয়।” [আল হুজুরাত/১৩] এর পরেও সকলে বরাবর হলে তাদের মাঝে লটারি করতে হবে। সাহাবী সাআ’দ বিন অক্কাস (রাযিঃ) একদা আযানের ব্যাপারে লটারি করেন। তাই আযানের ক্ষেত্রে এমন করা বৈধ হলে ইমামতির ক্ষেত্রে বেশী বৈধ হবে। [মুগনী,৩/১৬]
উল্লেখ্য যে, হানাফী মাজহাবের বিভিন্ন ফিকহের বইতে উপরে বর্ণিত হাদীসের ৪-৫ টি পদ্ধতির শুধু ধারাবাহিকতাই রক্ষা করা হয় নি; বরং তারা রায় ও কিয়াসের আশ্রয় নিয়ে ২০টিরও অধিক পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন, যাতে এমন কিছু বিষয় লিখেছেন যা রহস্যময়, লজ্জা জনক এবং অযৌক্তিক। যেমন দররে মুখতারের লেখক সেই সকল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে চেহারা-ছবি সুন্দর হওয়া, স্ত্রী সুন্দরী হওয়া এমন কি মাথা বড় হওয়া এবং যৌনাঙ্গ ছোট হওয়ার মত অযৌক্তিক ও লজ্জা জনক গুণাগুণকেও ইমামতির অগ্রাধিকারের কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। [দুররে মুখতার,২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৫, যাকারিয়া বুক ডিপো দেওবন্দের ছাপা/ ত্বরীকে মুহাম্মদী, মুহাম্মদ জুনাগড়ী,১৬২-১৬৮/ সালাফিয়্যাত কা তাআ’রুফ, ড.রোযাউল্লাহ,২৭২-২৭৭]
ইমামের বেতন-ভাতা:
ইমামের অবস্থা হিসাবে এ বিষয়ের বিধান প্রযোজ্য হবে। একজন ইমামের সাথে মোটামুটি নিন্মের অবস্থাগুলি সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে।
১- যদি ইমাম কেবল পার্থিব উদ্দেশ্যেই ইমামতি করে, তাহলে তা হারাম ও বড় গুনাহ। মনে রাখা উচিৎ যে, ইমামতি করা এবং আযান দেওয়া, উভয় শারয়ী কাজ এবং তা নিঃসন্দেহে ইবাদত। আর ইবাদত কবুলের প্রথম শর্তই হচ্ছে, ইখলাস। অর্থাৎ যে কোন ইবাদত তা যেন কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হয়, অর্থ পাবার উদ্দেশ্যে কিংবা পদ লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা নিজের সুন্দর কণ্ঠের মাধ্যমে লোকের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্য থাকলে, তাতে আর ইখলাস থাকে না। যার ফলে ইবাদতটি কবুল হয় না এবং তা ছোট শিরকে পরিণত হয় । কারণ ইবাদত, যা কেবল আল্লাহর জন্যই খাঁটি ভাবে হওয়া কাম্য, তাতে সে পার্থিব উদ্দেশ্য অংশী করেছে। তাই আক্বীদার পণ্ডিতগণ বলেন: মূল ইবাদতের মাধ্যমে কেবল দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্য, যেমন হজ্জ করা পয়সার জন্য, জিহাদ করা গনিমতের সম্পদ পাওয়ার জন্য, অনুরূপ [ইমামতি করা বেতনের জন্য], যাতে আল্লাহর কোন সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য থাকে না। এই প্রকারের আমল বাতিল, হারাম, বড় গুনাহ এবং ছোট শিরক। [দেখুন, তাসহীলুল আক্বীদা,ড.জিবরীন, পৃঃ৩৭৬]
আল্লাহ বলেন:
“যারা এ দুনিয়ার জীবন আর তার শোভা সৌন্দর্য কামনা করে, তাদেরকে এখানে তাদের কর্মের পুরোপুরি ফল আমি দিয়ে দেই, আর তাতে তাদের প্রতি কোন কমতি করা হয় না। কিন্তু আখেরাতে তাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছুই নাই। এখানে যা কিছু তারা করেছে তা নিষ্ফল হয়ে গেছে, আর তাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম ব্যর্থ হয়ে গেছে।) [হূদ,১৫-১৬]
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “অবশ্যই আমল সমূহ নির্ভর করে নিয়তের উপরে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পায়, যার সে নিয়ত করে থাকে।”। [বুখারী, নং১, মুসলিম, নং১৯০৭]
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন: “ যে ইলম আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্জন করা হয় কেউ যদি তা কেবল পার্থিব উদ্দেশ্যে তা করে তবে সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না”। [আহমদ,২/৩৩৮, আবু দাঊদ, নং (৩৬৬৪) ইবনু হিব্বান নং (৭৮)]
উপরোক্ত দলীল-প্রমাণের আলোকে একথা সুস্পষ্ট যে, ইমামতির উদ্দেশ্য যদি শুধু বেতন হয় কিংবা শুধু কোন পার্থিব লাভ হয়, তাহলে সেই ইমামতি বাতিল ও হারাম। তাই আমাদের ঐসকল ইমামদের চিন্তা করা প্রয়োজন যারা বেতন ছাড়া ইমামতি করেন না বা বেতনের চুক্তি করেই ইমামতি করেন; নচেৎ করেন না।
২- মূলত: ইমাম যদি সওয়াবের আশায় ইমামতি করে অতঃপর সরকার তাকে বায়তুল মাল থেকে ভাতা প্রদান করে, কিংবা কোন সংস্থা তাকে ভাতা দেয় কিংবা কোন ব্যক্তি তাকে এ কারণে সাহায্য দেয়, তাহলে তা গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই বরং তা জায়েজ। [ইসলামের শুরু যুগে যাকে বায়তুল মাল বলা হত, বর্তমান যুগে তা অর্থ মন্ত্রণালয় বলা যেতে পারে।]
সউদী ইফতা বোর্ডকে ঐ ইমামের পিছনে নামায পড়া বৈধতা বা অবৈধতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, যে এর ফলে সরকারী মজুরি নেয়। উত্তরে বোর্ড তাদের পিছনে নামায পড়া বৈধ বলে ফাতওয়া দেন এবং সেই ইমামের বেতন গ্রহণকেও বৈধ বলেন। বোর্ডের উত্তরটি নিন্মে উল্লেখ করা হল:
ফাতওয়া নং (৩৫০২) সরকারি মজুরি পায় এমন ইমামের পিছনে নামায আদায় বৈধ কি?
উত্তর: ‘হ্যাঁ। এমন ব্যক্তির পিছনে নামায পড়া বৈধ। কারণ সে মুসলিমদের সাধারণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাই মুসলিমদের বায়তুল মালে তার অধিকার রয়েছে, যা থেকে তার মজুরি প্রদান করা হবে। যেমন খুলাফা, আমীর, কাজী , শিক্ষক এবং এই রকম অন্যান্যদের তাদের দায়িত্ব পালন করার জন্য দেওয়া হয়। এই নিয়ম নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগ থেকে এখন পর্যন্ত চলে আসছে। অনুরূপ ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের তাদের দায়িত্ব পালনের কারণে আওকাফের পক্ষ থেকে দেওয়া শস্য গ্রহণও বৈধ।’ [সউদী স্থায়ী ফতোয়া কমিটি,৭/৪১৭]
ফিকাহ বিশ্বকোষে বর্ণিত হয়েছে, ‘এমন কাজে বায়তুল মাল থেকে অনুদান নেওয়া বৈধ, যার মাধ্যমে সকল মুসলিম উপকৃত হয়, যেমন বিচার বিভাগ, ফাতওয়া বিভাগ, আযান, ইমামত, কুরআন শিক্ষা এবং হাদীস ফিকাহ এর মত উপকারী বিদ্যা শিক্ষা ইত্যাদি। কারণ এ গুলো সাধারণ জনকল্যাণের অন্তর্ভুক্ত’। [মাওসূআ ফিকহিয়্যাহ,২২/২০২]
পূর্বসূরি উলামাগণ বায়তুল মালের অনুদানকে ‘বিনিময়’ (ইওয়ায) কিংবা ‘মজুরী’ (উজরাহ) বলেন নি বরং তাঁরা এটাকে ‘রায্ক’ অর্থাৎ জীবিকা বা দান বলেছেন।
ইবনে তায়মিয়্যাহ (রহঃ) বলেন: ‘আর যা বায়তুল মাল থেকে নেওয়া হয়, তা বিনিময় ও মজুরি নয়; বরং তা আনুগত্যের কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে অনুদান। আর সৎ কাজে অনুদান গ্রহণ কাজটিকে নৈকট্য থেকে বের করে না আর না ইখলাসে ব্যাঘাত ঘটায়; ব্যাঘাত ঘটলে গনিমতের হকদার হত না’। [প্রাগুক্ত,২২/২০২]
৩- বায়তুল মাল বা সরকারি ব্যবস্থাপনার অবর্তমানে যদি কোন সংস্থা বা মসজিদ কমিটি ইমামদের মাসিক সাহায্য বা অনুদান দেয়, তাহলে তা বায়তুল মালেরই স্থলাভিষিক্ত হিসাবে গণ্য হবে।
৪- ইমাম যদি অর্থশালী হয় তবে ইমামতির জন্য বেতন-ভাতা না নেওয়াই উত্তম। কিন্তু ইমাম যদি অভাবী হয় এবং ইমামতীর দায়িত্ব পালনের কারণে নিজস্ব প্রয়োজন ও তার সংসারের প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান দিতে অক্ষ হয় তবে তার জন্য এতখানি মাসিক বেতন বা সাহায্য নেওয়া বৈধ, যার মাধ্যমে তার ও তার সাংসারিক অভাব পূরণ হয়। আল্লাহ তাআ’লা ইয়াতীমের অভিভাবকদের আদেশ করেন:
“আর যে অভাব মুক্ত সে যেন বিরত থাকে আর যে অভাবগ্রস্ত সে যেন ন্যায়সঙ্গত ভাবে ভোগ করে।” [আন্ নিসা/৬]
তাই অনেকে অভাবী ইমামদের সাহায্য নেওয়াকে এই আদেশের উপর কেয়াস করত: বৈধ বলেছেন। তাছাড়া অভাবীর অভাব দূরীকরণ ইসলামের একটি সুন্দর মৌলিক বিধান।
উল্লেখ থাকে যে, ইমাম, মুয়াজ্জিন, দ্বীনের দাঈ এবং মক্তবের শিক্ষক যারা তাদের সময়ের অধিকাংশ এই রকম দ্বীনই কাজে ব্যায় করে থাকেন তাদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা সরকারকে বায়তুল মাল থেকে করা উচিৎ। সরকারি ব্যবস্থা না থাকলে ইসলামী সংস্থাগুলো করা প্রয়োজন। যদি এমন সংস্থাও না থাকে তাহলে এসব কাজের কমিটি এমনকি ব্যক্তি বিশেষকেও করা দরকার। কারণ উপরোক্ত সৎ কাজ সমূহ দ্বীনের ও মুসলিম সমাজের মৌলিক ও সাধারণ জনকল্যাণের কাজ, যা শূণ্য হয়ে গেলে বা হ্রাস পেলে ইসলাম ও মুসলিম সমাজের অপুরণীয় ক্ষতি সাধিত হবে।
৫- কোন অমুসলিম সরকার যদি ইমাম ভাতার ব্যবস্থা করে এবং এর বিনিময়ে সরকার যদি তাদের উপর কোন অবৈধ কাজের শর্তারোপ না করে, তাহলে সাধারণত: সেই ভাতা গ্রহণ বৈধ হবে। কারণ লেনদেনের মূলনীতি হচ্ছে, বৈধতা। তাছাড়া মজুরি গ্রহণের ক্ষেত্রে মজুরিদাতার মুসলিম হওয়া শর্ত নয়। [ওয়াল্লাহু আ’লাই]
ইমামতি ছাড়া ইমামের কিছু পছন্দনীয় কাজ:
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, একজন ইমামের মূল দায়িত্ব হচ্ছে ইমামতি করা। সে একজন আমানতদার হিসাবে নিষ্ঠার সাথে তার দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু যেহেতু সে মুসাল্লীদের দৃষ্টিতে আদর্শ, সেহেতু তাকে এই দায়িত্বকে গনিমত ভেবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা দরকার এবং তাকে এমন কিছু দ্বীনী ও সামাজিক কাজ আঞ্জাম দেওয়া প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সেই মসজিদের মুসল্লীবর্গ সহ সেই গ্রাম ও মহল্লার লোকেরা যেন সঠিক দ্বীন জানতে পারে, ইসলামি আদর্শে আদর্শবান হতে পারে এবং সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারে।
সম্মানিত ইমাগণের উদ্দেশ্যে নিন্মে কিছু ভাল কাজের সূচী প্রদত্ত হল:
  • ১- মুসাল্লীদের সংখ্যা ও উপযুক্ত সময়ের দিকে খেয়াল রেখে দৈনন্দিন কোন নামায শেষে সংক্ষিপ্ত ৮-১০ মিনিট বিভিন্ন আলোচনার ব্যবস্থা করা। এই ক্ষেত্রে সুন্দর নিয়ম হল, কোন যোগ্য আলেমের বই ধারাবাহিক ভাবে পাঠ করা। আক্বীদা, পাক-পবিত্রতা, নামাযের নিয়ম-পদ্ধতি, ইসলামি শিষ্টাচার, হালাল-হারাম ও এই ধরনের বিষয়াদিকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার।
  • ২- মৌসুম অনুযায়ী বিষয় পরিবর্তন করা এবং সে হিসাবে আলোচনা করা। যেমন রামাযান মাসে রোযার বিভিন্ন মাসায়েল, কুরবানী ও হজ্জের সময় সে সব মাসায়েল, ফসলাদি কাটার সময় উশর-যাকাতের মাসায়েল। বর্তমান সউদী আরবের বেশীর ভাগ মসজিদে এই নিয়ম লক্ষ্য করা যায়।
  • ৩- মক্তব-মাদ্রাসার ব্যবস্থা থাক কিংবা না থাক, কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে শিশুদের সাথে সাথে বড়দের জন্যও আলাদা ভাবে ব্যবস্থা করা।
  • ৪- মসজিদে মহিলাদের নামায পড়ার ব্যবস্থা না থাকলে, ব্যবস্থা করতে মুসাল্লীদের উদ্বুদ্ধ করা।
  • ৪- পর্দার ব্যবস্থা করে মহিলাদের জন্য মাসিক বা পাক্ষিক দ্বীন শিক্ষা ও দাওয়াতের ব্যবস্থা করা।
  • ৫- মাঝে মাঝে মসজিদে সকাল সন্ধ্যা ও নামায শেষে পঠনীয় দুয়া ও যিকির শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
  • ৬- নিজের সম্মান বজায় রেখে অন্যের পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসায় অংশ নেওয়া।
  • ৭- ধীরে ধীরে মসজিদ লাইব্রেরী গঠন করা। মসজিদ লাইব্রেরী বলতে সেই গ্রন্থ সমাহারকে বুঝায় যা ইসলামের মৌলিক গ্রন্থ হিসাবে পরিচিত এবং যা মসজিদে পঠন-পাঠনের জন্যই নির্দিষ্ট। যেমন কুরআন, কুরআনের তাফসীর, বুখারী মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ এবং কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ফিকাহ গ্রন্থ। এর মাধ্যমে যেমন ইমাম স্বয়ং উপকৃত হয়, তেমন মুসাল্লীরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচক্ষে দলীল-প্রমাণ দেখতে পায়।
  • ৮- আগ্রহ ও ইখলাসের সহিত অসুস্থ মুসল্লীদের যিয়ারত করা এবং তাদের জানাযায় শরীক হওয়া; কারণ এটা যেমন নেকীর কাজ, তেমন এক মুসলিম ভাইর প্রতি অপর মুসলিম ভায়ের অধিকার ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির বিরাট বড় উপায়।
  • ৯- মাঝে মাঝে ভাল আলেমকে নিয়ে এসে বিশেষ আলোচনার ব্যবস্থা করা।
  • ১০- মাঝে মাঝে মসজিদের আয়োজনে ও তত্ত্বাবধানে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
যে সব কাজ থেকে ইমামকে বিরত থাকা উচিৎ:
যেহেতু ইমামতি একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনই পদ, সেহেতু ইমামকে যেমন এই কাজের যোগ্য হতে হবে, তেমন তাকে আরো কিছু মহৎ গুণের অধিকারী হওয়া উচিৎ যেমন, সততা, সত্যবাদিতা, চরিত্রবান এবং এই ধরনের অন্যান্য ভাল গুণ। এই সব আনুষঙ্গিক গুণ থাকলে তার কথার ও আদেশ-উপদেশের সমাজে সহজে প্রভাব পড়বে এবং তা গ্রহণীয় হবে। কিন্তু কারো মধ্যে উপরে বর্ণিত ইমামতির হকদারের গুণগুলি থাকলেও যদি এই আনুষঙ্গিক গুণগুলি না থাকে, তাহলে সেই ইমাম সাধারণত: তার সমাজে কামিয়াব ইমাম বিবেচিত হয় না। তাই প্রত্যেক ইমামকে তার সমাজে প্রচলিত কিছু এমন কাজ-কর্ম ও অভ্যাস থেকে বিরত থাকা উচিৎ, যা করলে স্বয়ং সে দ্বীনের দিক থেকে লাভবান হতে পারবে, তার কথা ও কাজ অধিক গৃহীত হবে এবং] সে আত্মমর্যাদার জীবন-যাপন করবে। ইনশাআল্লাহ।
  • ১- গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণত: কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত না থাকা। কারণ তিক্ত হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোক কোন না কোন ভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত কিংবা প্রভাবিত। যার ফলে তারা ইসলামের দৃষ্টিতে নয়; বরং রাজনীতির নীতিতে একে অপরকে ভাল-মন্দ বিবেচনা করে থাকে। তাই ইমাম কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত হলে প্রথমেই সে মুসাল্লীদের একটি বড় অংশের অন্তর থেকে বাদ পড়ে যাবে এবং তার মূল উদ্দেশ্য বিফল হয়ে যাবে। অতঃপর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হবে। পরিশেষে হয়ত: ইমামতি হারাতে হবে, বেইজ্জত হতে হবে, সমাজ ভেঙ্গে যাবে আর অনেক সময় মসজিদ ভেঙ্গে আরো একটি মসজিদ নির্মাণ হবে, যা খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।
  • ২- আত্মমর্যাদার সবসময় খেয়াল রাখা। নিজের অভাব-অনটন ও মুখাপেক্ষিতা সবার কাছে পেশ না করা তার হাবভাবে প্রকাশ না করা। কারণ এর ফলে ইমাম তার মুসাল্লীদের ও গ্রামবাসীদের নজরে ছোট হয়ে যায়, মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। ফলস্বরূপ তার আদেশ-উপদেশও তাদের কাছে হাল্কা হয়ে যায়। অনেক সময় লোক তাকে মর্যাদা দেয়া তো দূরের কথা তাকে দেখলেই উপহাসের ছলে কথা বলে।
  • ৩- কুরআন ও দ্বীনই শিক্ষার দায়িত্ব থাকলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পড়ার ব্যবস্থা করা। সম্ভব না হলে ছেলেদের সাথে শুধু নাবালিকা মেয়েদের পড়ার দায়িত্ব ভার নেওয়া। কারণ এটা যেমন দ্বীনই বিধান তেমন অনেক শয়তানী চক্রান্ত ও বদনাম থেকে বাঁচার উপায়।
  • ৪- কেবল প্রয়োজনে বৈধ ঝাড়-ফুঁক করা। কিন্তু এটাকে নিজের পেশা বা স্বভাবে পরিণত না করা। কারণ একাজ সাধারণত: বৈধ দিয়ে শুরু হয় এবং পরে বিভিন্ন কারণে হারামে পরিণত হয়। (যেমন, তাবিজ ব্যবসা)
  • ৫- মহল্লা বা গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাওয়া ছাড়া অংশ না নেওয়া এবং এ বিষয়ে ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য না করা। এসব অনুষ্ঠানের ফলে কিছু পাওয়ার লোভ না করা আর না কিছু চুক্তি করা। তবে না চাইতে কেউ কিছু দান করলে তা গ্রহণ করা অবৈধ নয়।
  • ৬- বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্বন্ধে শারিয়ার বিধান স্পষ্ট করে বলে দেওয়া এবং নিজের জন্য এ সম্পর্কে সেই বিধান অনুযায়ী একটি সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা, যেন আপনার কোথাও অংশ নেওয়া বা না নেওয়া সেই শারঈ কারণে হয়। যার ফলে আপনি বলতে সক্ষম হবেন যে, আপনি কোন অনুষ্ঠানে কেন যান আর অন্য অনুষ্ঠানে কেন উপস্থিত হন না।
লেখক: শাইখ আব্দুর রাকীব মাদানী, দাঈ, খাফজী দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।