মতামত প্রকাশে ইসলামের স্বীকৃতি
ড. আফম খালিদ হোসেন
গঠনমূলক সমালোচনাকে ইসলাম সবসময় স্বাগত জানায়। ভিন্নমতের প্রতি ইসলামের আচরণ সহানুভূতিপূর্ণ। কারণ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে সুষ্ঠু সমাজ গঠন ও পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই যে জাতি যত বেশি সহনশীল, ওই জাতি তত বেশি সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও অগ্রসর। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন, আস্থা অর্জন ও সৌহার্দ সৃষ্টির জন্য পরমতসহিষ্ণুতার গুণ অপরিহার্য পূর্বশর্ত। পবিত্র কোরআন সহিষ্ণুতার মহৎ গুণটি অর্জনের জন্য জোরালো ভাষায় তাগিদ দিয়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে এটা ঠিক, তবে সেটাকে বল্পাহীন করেনি। কারণ কোনো উগ্র মতামত ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য যদি অপরের, দলের, জাতি, গোষ্ঠীর ও ধর্মের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে আহত করে অথবা সমাজে ফেতনা-ফ্যাসাদের জন্ম দেয়, তাহলে তা বর্জনীয়। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, 'তারা সত্যের আদেশ দেয় এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখে।'
উপর্যুক্ত গুণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না। বর্ণিত আয়াতে শুধু ওই স্বাধীনতার গ্যারান্টিই নিশ্চিত করে না বরং এই স্বাধীনতাকে ব্যবহার করার পথও নির্দেশ করে দেয়। একজন মুসলমান মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে শুধু সত্য ও কল্যাণের বিকাশে ব্যবহার করতে পারেন। অসত্য ও অন্যায় প্রচারে এই স্বাধীনতা ব্যবহৃত হতে পারে না। কারণ এটা মোনাফেকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, 'তারা অন্যায়ের আদেশ দেয় এবং সত্য ও কল্যাণে বাধাদান করে।' (আত তাওবা : ৬৭)। পবিত্র কোরআনে বনি ইসরাইলের পতনের অন্যতম কারণ নির্দেশ করে বলা হয়েছে, 'তারা যেসব গর্হিত কাজ করত তা থেকে তারা একে অন্যকে বারণ করত না। তারা যা করত তা কতই না নিকৃষ্ট।' (আল মায়িদা :৭৯)। 'মজলুমের এটা অধিকার যে জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখে উচ্চারণ করবে_ এটা করতে গিয়ে যদি ভাবাবেগে শালীন ও পরিশীলিত বক্তব্য রাখতে অক্ষম হয় তাহলে তাকে আল্লাহর কাছে এ জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হবে না।' (মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, বুনিয়াদি হুকুক : পৃ. : ২৬৬)।
ইতিহাস একথা স্পষ্ট সাক্ষী দেয় যে, মদিনা প্রজাতন্ত্রের জনগণ নির্বিঘ্ন ও নির্ভয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও চার পুণ্যবান খলিফার সামনে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারতেন। মহানবীর (সা.) অভ্যাস ছিল যে, বিভিন্ন বিষয়ে তিনি সাহাবায়ে কেরামের মতামত নিতেন এবং মত প্রকাশে উৎসাহিত করতেন। ওহুদের যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.) এবং বিশিষ্ট সাহাবাদের মত ছিল মদিনা শহরের অভ্যন্তরে অবস্থান করে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া; কিন্তু হজরত হামজাহ (রা.) এবং অপেক্ষাকৃত যুবক সাহাবারা শহরের বাইরে কোনো উন্মুক্ত প্রান্তরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের এই মতামত গ্রহণ করে ওহুদের প্রান্তরে কোরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। একদা মহানবী (সা.) যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করছিলেন। একজন বলে ওঠেন, 'গনিমতের বণ্টন আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থী হয়েছে।' রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধু জবাব দিলেন, 'আমি যদি ইনসাফ না করি তাহলে ইনসাফ করবে কে?' কিন্তু ভিন্ন মত পোষণকারীদের মুখ বন্ধ করে দেননি।
হজরত জুবায়ের (রা.) এবং আনসারীর মধ্যে সৃষ্ট বিরোধের এক মামলা বিশ্বনবীর (সা.) আদালতে প্রেরিত হয়। সাক্ষী-প্রমাণ ও তথ্যাদি যাচাই করে বিশ্বনবী (সা.) হজরত জুবাইরের অনুকূলে রায় প্রদান করেন। কিন্তু আনসারী ক্রোধান্বিত হয়ে মন্তব্য করেন, 'আপনি ফুফাতো ভাইয়ের পক্ষে রায় দিলেন।' এটা ছিল বিশ্বনবীর (সা.) সততা ও ন্যায় ইনসাফের প্রতি খোলা চ্যালেঞ্জ; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে ক্ষমা করে দেন। ভিন্নমতের জন্য কোনো শাস্তি দেননি। এক যুদ্ধ অভিযানের সময় মহানবী (সা.) মুসলমানদের হুকুম দিলেন যে, অমুক অমুক জায়গায় তোমরা শিবির স্থাপন করো। এক সাহাবি জানতে চাইলেন এই হুকুম আল্লাহ প্রদত্ত ওহি, না আপনার ব্যক্তিগত অভিমত? রাসূল বলেন, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সাহাবি উত্তর দিলেন অমুক জায়গা শিবির স্থাপনের উপযোগী নয় বরং এর পরিবর্তে অমুক অমুক স্থান শিবির স্থাপনের উপযোগী এবং সহায়ক। আল্লাহর রাসূল নিঃসঙ্কোচে সাহাবির এই অভিমত মেনে নেন।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) মতামতের স্বাধীনতা অনুমোদন করে জনগণের উদ্দেশে বলেন, 'আমাকে অনুসরণ করো যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করব। যদি আমি গোমরাহির পথে পরিচালিত হই তবে তোমরা আমাকে সঠিক পথের দিশা দেবে।' হজরত ওমর (রা.) ক্ষমতায় থাকাকালীন বক্তৃতারত অবস্থায় মদিনার জনগণকে বলেন, 'আমি যদি ভুল পথে পরিচালিত হই তখন তোমরা কী করবে?' তাৎক্ষণিকভাবে একজন উত্তর দিলেন, 'এই তরবারি দিয়ে সোজা পথে নিয়ে আসব।' পরমতসহিষ্ণুতার এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে দুনিয়াবাসী অভিভূত হয়েছে। হজরত ওমরের (রা.) খিলাফতকালে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রাদেশিক গভর্নরের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মতামত ও অভিযোগ পেশ করতে পারতেন। যে কোনো নাগরিকের ভিন্নমত প্রকাশে বাধা দেয়া হতো না। হজরত আমর ইবনে আস (রা.), হজরত মুগিরা ইবনে শোবা (রা.), হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) ও হজরত সা'দ ইবনে ওয়াক্কাসের (রা.) মতো খ্যাতনামা প্রাদেশিক গভর্নরদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো হজরত ওমর (রা.) প্রকাশ্যে জনসমক্ষে শুনানি করতেন।
একবার আবক্ষাসীয় খলিফা বাদশাহ হারুনুর রশীদ হজ করতে গেলেন। কাবাগৃহ তাওয়াফ করার সময় আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ডাক দিয়ে বলেন, 'বলুন তো এ বছর কত মানুষ হজ সম্পাদন করছেন?' খলিফা বলেন, 'এর সঠিক সংখ্যা তো একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।' আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেন, হে আল্লাহর বান্দা! এ কথা ভুলে যাবেন না, এ বিশ্ব চরাচরে যত মানুষ আছে প্রত্যেকে নিজের কর্মকান্ডের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর কাছে দায়ী আর আপনাকে আপনার শাসনাধীন জনগণের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। একটু ভেবে দেখুন, হিসাব নেয়ার সময় আপনার কী অবস্থা হবে? প্রতাপশালী সম্রাট এই বক্তব্য শুনে কান্না জুড়ে দেন এবং আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে এই মতামতের জন্য কিছু বললেন না। (রঈস আহমদ জাফরী : ইসলামী জামহুরিয়াত : পৃ. : ১৬৪)। এই কথা মনে রাখা দরকার যে, ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের ধর্মবিশ্বাস ও নিজস্ব চিন্তাধারা পোষণ ও লালনের অধিকার রয়েছে। পবিত্র কোরআনের ফায়সালা, 'ধর্মের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে।' (বাকারাহ : ২৬৫)। মানবজাতির প্রতি মহানবী (সা.) দায়িত্ব ব্যাখ্যা করে মহান আল্লাহ বলেন, 'অতএব আপনি উপদেশ দিতে থাকুন, আপনি তো উপদেশদাতা। আপনি তো তাদের জোর-জবরদস্তিকারী (কর্মনিয়ন্ত্রক) নন।' (আল গাশিয়াহ : ২১-২২)।
ওয়াসাক রুমী নামের এক খ্রিস্টান ক্রীতদাস বহু বছর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) কাছে ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমি হজরত ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) ক্রীতদাস ছিলাম। তিনি আমাকে বলতেন, মুসলমান হয়ে যাও, যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো তাহলে আমি তোমাকে মুসলমানদের আমানতদারীর কোনো দায়িত্ব অর্পণ করব।' কিন্তু আমি ইসলাম কবুল করিনি। এতে হজরত ওমর (রা.) বলেন, 'লা ইকরাহা ফিদ্দিন।' (ধর্মের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি নেই)। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি আমাকে মুক্ত করে দেন এবং বলেন, 'তোমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে চলে যেতে পারো।' (আবু উবাইদ : কিতাবুল আমওয়াল, পৃ. : ১৫৪)। এ ঘটনা প্রমাণ করে, ইসলামের অপরাপর জনগোষ্ঠীকে দাওয়াত দেয়ার নিয়ম আছে; কিন্তু জোর করে ধর্মান্তরিত করার বিধান নেই_ হজরত ওমরের এই সহনশীল ঘটনাই তার দৃষ্টান্ত।
পরিশেষে আমরা একথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ইসলাম সবসময় সহিষ্ণু মনোভাব প্রদর্শন করেছে। কারণ সহনশীলতার অভাবে মত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হলে সুষ্ঠু সমাজ বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বিবেকের স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তি হয়ে পড়ে স্থানু ও নির্জীব। চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বিবেকের স্বাধীনতা সুশীল সমাজের ও সভ্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব স্বাধীনতা ব্যক্তির সহজাত অধিকার (Natural Rights)। ইসলামে রয়েছে এসব অধিকারের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। পাশ্চাত্য চিন্তাবিদরা ব্যক্তির পাঁচটি অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে ইসলাম মানুষের সতেরটি অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা তন্মধ্যে অন্যতম। ইসলাম ব্যক্তির অধিকারের (Rights) পাশাপাশি নৈতিক বাধ্যবাধকতাকেও (Obligation) সমান গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম মানুষের অধিকার রক্ষার সবচেয়ে বড় ঝান্চা বাহী।
No comments:
Post a Comment